বোরিস এসে উঠল পিকআপের পেছনে। চ্যাপ্টা হয়ে থাকা কার্ডবোর্ডের বড় একটা বাক্স ঠিকঠাক করে তার মধ্যে একটা মূর্তি ঢুকিয়ে ভালমত বাঁধল। তার প্রতিটি কাজের ওপর চোখ রেখেছে নীল সিড্যানে বসা দুই কালো-গুফো। রেডিওতে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। জিকো, জ্যাকি আর রাইসের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে।
মূর্তি বাক্সে ঢুকিয়ে বেঁধেছে ভালুকটা, মাইক্রোফোনে মুখ প্রায় ঠেকিয়ে কথা বলছে জিকো। ছেলেটা এখনও বাড়ির ভেতরে…
ভাঙা চেয়ারে বসে সব শুনছে কিশোর।
কথা শেষ হলো জিকোর। নির্দেশ দিল রাইস, বাক্সটা নামাও! শোনো, এক কাজ করো। একটা নকল দুর্ঘটনা ঘটাও
পিকআপটা স্টার্ট নিলেই গিয়ে ওটার সামনে দাঁড়িয়ে যাও, চলতে শুরু করলেই পড়ে যাওয়ার ভান করবে, ধাক্কা খেয়ে যেন পড়ে গেছ। চেঁচাতে শুরু করবে। লোকজন জমে যাবে। ছেলেটা আর ড্রাইভার নেমে পড়বে কতখানি চোট লেগেছে দেখার জন্যে। এই সুযোগে…
দাঁড়াও, দাঁড়াও, দরকার নেই! চেঁচিয়ে বাধা দিল জিকো। ভালুকটা আবার বাড়ির ভেতরে যাচ্ছে। ট্রাকে কেউ নেই। নামিয়ে আনতে পারব।
নীরব হয়ে গেল রেডিও। পারছে না, তাই, নইলে দড়ি ছিঁড়ে উড়ে চলে যেত এখন কিশোর। যা-ও বা অকটেভিয়ানের মূর্তিটা খুঁজে পাওয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গেই হারাতে হচ্ছে আবার।
বাগানে এসে ঢুকল আবার বোরিস।
একনাগাড়ে বকে চলেছে মেয়েটা, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে রবিন।
আচ্ছা, মেয়ে গোয়েন্দার দরকার নেই তোমাদের? আগ্রহে সামনে। মাথা বাড়িয়ে দিয়েছে রুসা। আমার তো মনে হয়, দলে একটা মেয়ে থাকা উচিত। অনেক সময় অনেক রকম সাহায্য হবে, যা ব্যাটাছেলেকে দিয়ে হয় না। আমাকে নিতে পারো। খুব ভাল অভিনয় করতে পারি, বিশ্বাস না হলে মাকে জিজ্ঞেস করে দেখো, যে-কোন মানুষের গলা নকল করতে পারি, আর…।
এই, রবিন, ডাকল বোরিস। আর কতক্ষণ! মিসেস পাশা জলদি করতে বলে দিয়েছে। চলো।
হ্যাঁ, এই যে, আসছি, রবিন বলল। সরি, রুসা, আমাকে যেতে হচ্ছে। হয়তো মেয়ে একজন দরকার হতে পারে আমাদের। যদি হয়, তোমাকেই আগে খবর দেব।
এক সেকেণ্ড, প্লিজ! আমি আসছি, রবিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছুটে বাড়ির ভিতরে চলে গেল রুসা। ফিরে এল যেন চোখের পলকে। হাতে একটা চারকোনা সাদা কার্ড, আর পেনসিল। এই যে, নাও, ফোন নম্বর আর আমার নাম লিখে দিয়েছি। প্লিজ, রবিন, ভুলো না! আমাকে খবর দিয়ো! সত্যিকার গোয়েন্দাদের সঙ্গে কাজ করতে পারলে ধন্য হয়ে যাব। প্লিজ!
কার্ডটা হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল রবিন, তার পাশে বকবক করতে করতে চলল মেয়েটা।
ট্রাকে এসে উঠল রবিন আর বোরিস। ঘুরে গলি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন নীল সিড্যান, দেখল দুজনেই, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ হলো না, বাক্সে বাধা মূর্তি চলে যাচ্ছে।
হাত নেড়ে গুডবাই জানাল রুসা। কিশোর আর মুসাকে নিয়ে আরেকদিন এসে চা খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করল চেঁচিয়ে।
গাড়ি ছেড়ে দিল বোরিস।
মোড় নিয়ে বড় রাস্তায় পড়ার আগে জানালা দিয়ে মুখ বের করে পেছনে তাকাল রবিন, এখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে রুসা, রবিনকে দেখে আরেকবার হাত নাড়াল।
চুপ হয়ে গিয়েছিল, আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল রেডিও। কানে এল জিকোর গলা।
পেয়েছি! জিকো বলছে। ওরা কল্পনাও করতে পারেনি, মূর্তিটা আমরা নিয়ে এসেছি।
গুড! বলল রাইস। গোপন আড়োয় নিয়ে যাও। খবরদার, আমরা। আসার আগে খুলো না। ওভার অ্যাণ্ড আউট।
ওভার অ্যাণ্ড আউট! বলে নীরব হয়ে গেল রেডিও। কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল রাইস, বিচ্ছিরি হাসি, ঠোঁটের এক কোণ ঝুলে পড়ছে। খোকা, বেঁচে গেলে। আমাদের জিনিস আমরা পেয়েছি। এখুনি অবশ্য তোমাদেরকে ছাড়তে পারছি না, তোমার বাড়িতে ফোন করে খবর দেব কোথায় আছ। তবে দেরি হবে, রাতের আগে। বোধহয় পারব না। ততক্ষণ বসে থাকো এখানে।
হ্যারিসনকে ডাকল রাইস।
তারপর তিনজনে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে একবার ফিরে তাকাল হ্যারিসন, কিশোরের জন্যে কিছু করতে পারেনি বলে দুঃখিত মনে হচ্ছে ওকে। বুড়ো মানুষ, দুই ডাকাতের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না। বোঝাই যাচ্ছে।
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর মিনিটখানেক অপেক্ষা করল কিশোর। তারপর চেঁচিয়ে ডাকল, মুসাআ! গাআস! শুনছও!
কিশোওর! মুসার চাপা কণ্ঠ ভেসে এল, দুটো বন্ধ দরজার জন্যে আওয়াজ অস্পষ্ট। কী হচ্ছে? আমাদের বের করতে পারবে? লাইটের। ব্যাটারি শেষ!
সরি, সেকেণ্ড! জবাব দিল কিশোর। আমি নিজেই আটকে আছি। দড়ি পেঁচিয়ে মমি বানিয়ে রেখেছে আমাকে। অকটেভিয়ানকেও পেয়ে গেছে ওরা!
চোদ্দ
ভাবছে কিশোর, কী করে মুক্তি পাওয়া যায়! জানালার চৌকাঠে ফেলে গেছে ওরা তার ছুরিটা। ওখানে যাওয়া সম্ভব না, আর কোন অলৌকিক উপায়ে যেতে পারলেও দড়ি কাটা তো দূরের কথা, ওটা হাতে নিতে। পারবে না।
কিন্তু মুক্তি তো পেতেই হবে! ওরা বলে গেছে বটে। কিন্তু কখন। ফোন করবে না রবে ঠিক আছে?
নিচে জোর ধাক্কার শব্দ শোনা গেল। বন্ধ দরজায় গায়ের জোরে ধাক্কা মারছে মুসা আর অগাস্ট, তারই আওয়াজ। ভেঙে ফেলতে চাইছে পাল্লা।
ধাক্কা দেয়া থামল। চিৎকার শোনা গেল মুসার, কিশোর, এই, কিশোর! শুনছ?
শুনছি! জবাব দিল কিশোর। কী খবর!
নড়ছেও না। কাঁধ ব্যথা করে ফেলছি আমরা! ভীষণ অন্ধকার!