সিঁড়ি বেয়ে দুপদাপ করে নেমে আসছে লোক দুজন।
ধরো, ধরো ওকে, জ্যাকি! চেঁচিয়ে উঠল ভারি কণ্ঠ। ওর কথাই বলেছি।
শক্তিশালী একটা থাবা কিশোরের হাত চেপে ধরল, মুচড়ে নিয়ে এল পিঠের ওপর। আরেক হাতে শার্টের কলার চেপে ধরে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলল ওপরে।
ভাঁড়ার থেকে শব্দ শুনেই বুঝল মুসা আর অগাস্ট, কিশোরকে ধরে। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ধরে ফেলল! ঢোক গিলল মুসা, গলা শুকিয়ে কাঠ।
নিয়ে যেতে বারোটা বাজছে ওদের, অগাস্ট বলল। শুনছ, কী রকম শব্দ হচ্ছে? জোরাজুরি করছে ভীষণ।
ব্যথায় আহহ! করে চেঁচিয়ে উঠল একজন।
হাতে কামড় দিয়েছে বোধহয়। হাসল অগাস্ট।
চটাস করে চড় পড়ার শব্দ হলো, থেমে গেল জোরাজুরির শব্দ।
দুজন মিলে একজনকে ধরেছ, লজ্জা করে না! আবার মারছ! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
বেশ, তা হলে চুপ হয়ে যাও, খসখসে কণ্ঠ বলল।
হ্যাঁ, শান্তভাবে উঠে এসো, মারব না, বলল ভারি কণ্ঠ। নইলে কপালে আরও দুঃখ আছে।
আরও দুটো তো রয়ে গেল, খসখসে গলা।
থাক, ভারি কণ্ঠ। একেই আমাদের দরকার।
দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল, ছিটকিনি লাগাল, আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল পদশব্দ।
কিশোর চুপ হয়ে গেছে, শব্দ করে শ্বাস ফেলল অগাস্ট।
তো আর কী করবে? দুজনের সঙ্গে পারবে না, খামোকা মার খাবে আরও।
ও পড়ল ডাকাতের হাতে, আমরা আটকা পড়লাম এখানে। আগে ছিল একটা, এখন দুটো দরজাই বন্ধ। বেরোনোর আশা শেষ।
কিশোর যখন বাইরে রয়েছে, আশা পুরোপুরিই আছে। কোন একটা উপায় ও ঠিক করে ফেলবে, বের করে নিয়ে যাবে আমাদের, গভীর আস্থা মুসার কণ্ঠে।
তবে, মুসা বন্ধুর অবস্থাটা জানে না। কিশোর নিজেই ছুটতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে, থাক তো অন্য দুজনকে মুক্ত করা। হাত পিঠের ওপর মুচড়ে ধরে তাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে ভারিকণ্ঠ। রান্নাঘরে নিয়ে এল। একটা আসবাব আছে এখনও, একটা চেয়ার, এতই পুরানো, নড়বড়ে, ভাঙা; বাতিল মালের ক্রেতারাও নেয়নি, ফেলে গেছে।
ভারি কণ্ঠ বেঁটে, মোটা। খসখসে গলা বিশালদেহী। দুজনেরই কালো গোঁফ, ভারি হর্নরিমড চশমা। ইয়ার্ডে যে কালো-গুফো গিয়েছিল, তারও একই রকম গোঁফ আর চশমা ছিল, তবে এদের কেউ নয়।
হাত ছেড়ে দিয়ে কিশোরের কাধ চেপে ধরল ভারি কণ্ঠ, ঠেলে নিয়ে গিয়ে চাপ দিয়ে বসিয়ে দিল চেয়ারে।
বাড়ির পেছনে কাপড় শুকানোর দড়ি আছে, দেখেছি, খসখসে গলাকে বলল সে। যাও তো, চট করে নিয়ে এসো।
বেরিয়ে গেল লোকটা।
কিশোরের দেহ তল্লাশি করল ভারি কণ্ঠ দক্ষ হাতে, ছুরিটা বের করে নিল। দারুণ জিনিস তো! বেশ ধার। নাক আর কান অতি সহজেই কেটে নেয়া যাবে, কিশোরের দিকে চেয়ে হাসল সে।। চুপ করে ভাবছে গোয়েন্দাপ্রধান। ভারি কণ্ঠকে শিক্ষিতই মনে হচ্ছে, সাধারণ চোর-ডাকাতের মত লাগছে না। খসখসে গলা অবশ্য সাধারণ গুণ্ডাই, তবে, ভরসা এই যে, আদেশের মালিক ভারি কণ্ঠ।
ছোটখাট একজন মানুষ দেখা দিল দরজায়, ধূসর চুল, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। বোধহয় ও-ই হ্যারিসন। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, আরে, মারছেন নাকি? আমাকে কথা দিয়েছিলেন, খুনখারাপীতে যাবেন না, মনে আছে?
যাও এখান থেকে! ধমকে উঠল ভারি কণ্ঠ। খুন করব কি করব না, ওর ওপর নির্ভর করছে। কথামত চললে কিছুই করব না, নইলে…তুমি যাও এখান থেকে।
দ্বিধাজড়িত পায়ে আস্তে করে পিছিয়ে গেল হ্যারিসন।
দড়ি নিয়ে এল খসখসে গলা। দুজনে মিলে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধল। কিশোরকে। দুই হাত চেয়ারের হাতার সঙ্গে, পা চেয়ারের পায়ার সঙ্গে, কোমর পেচিয়ে পেচিয়ে বাধল চেয়ারের পেছনের সঙ্গে। মাথা ছাড়া শরীরের আর কোন অঙ্গই নড়ানোর উপায় থাকল না কিশোরের।
তারপর, খোকা, আলাপী ভঙ্গিতে বলল ভারি কণ্ঠ, চুনিটা কোথায়?
জানি না, আমরাও খুঁজছি।
সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, রাইস। তুমি সরা, আমি দেখছি, জানালার চৌকাঠে রাখা আছে কিশোরের ছুরিটা, তুলে নিল খসখসে গলা। বেছে বেছে পাতলা একটা ফলা খুলল, ক্ষুরের মত ধার, ঝকঝক করছে। কোন গালে আগে পোচ লাগাব, খোকাবাবু? নিজের রসিকতায় নিজেই খিকখিক করে বিচ্ছিরি হাসি হাসল।
তুমি থামো! ধমক দিল রাইস। আমি কথা বলছি ওর সঙ্গে। সত্যিই বোধহয় জানে না। তবে, অনুমান করতে পারবে। কিশোরের দিকে তাকাল। অগাস্টাসের মাথায় নকল পাথরটা ঢোকাল কেন, বলতে পারবে?
মনে হয় লোককে বিপথগামী করার জন্যে।
আসলটা তা হলে কোথায়?
হয়তো আরেকটা মূর্তির ভেতরে, যেটাকে লোকে ভাবনার বাইরে রাখবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিশোর, সত্যি কথাই বলবে। অকটেভিয়ান কোথায় আছে জানে না, তোক দুটোও নিশ্চয় জানে না, কাজেই সত্যি কথা বলেও ক্ষতি নেই। বরং লাভ। তাকে মুক্তি দিয়ে দেবে হয়তো। আমার ধারণা, অকটেভিয়ান।
অকটে…ঠিক, ঠিক বলেছ! নিজের হাতেই চাপড় মারল লোকটা। রোমের সম্রাট ছিল অকটেভিয়ান, আরেক নাম অগাস্টাস। অগাস্টাস থেকে অগাস্ট। ঠিক। সঙ্গীর দিকে ফিরল সে। কী বুঝলে, জ্যাকি?
অ্যাঁ, হ্যাঁ! ঘাড় চুলকাচ্ছে জ্যাকি। ঠিকই তো মনে হচ্ছে। তা হলে, খোকা, এবার ফাস করো তো, কোথায় আছে অকটেভিয়ান?
জানি না, মাথা নাড়ল কিশোর। কার কাছে জানি বিক্রি করে দিয়েছে চাচী। কে কী কিনল, নামধাম তো আর লিখে রাখা হয় না, জানাও সম্ভব না। তবে, লস অ্যাঞ্জেলেসের কেউই হবে।