অথচ নকলটার জন্যেই জিকোর অবস্থা কাহিল! আহা, বেচারা! হাসল খসখসে গলা।
হাসি শুনে কেঁপে উঠল মুসা, ভয়ঙ্কর হাসি। ছুরির ফলা থেকে তিন ফোঁটার রক্ত মুছে ফেলার কথা মনে পড়ল।
হাসিঠাট্টার সময় না এটা, ভারি কণ্ঠ আরও ভারি শোনাল। যা বলছিলাম, অগাস্টাসের ভেতরে নকল পাথর কেন? নিশ্চয় বিপথে সরানোর জন্যে। আমি বলছি, আসল চুনিটা এই বাড়িতেই আছে কোথাও।
তা হলে আমার আর কিছু বলার নেই, হ্যারিসনের গলা। পুরো বাড়িটা ভেঙে দেখতে পারেন এবার। কসম খেয়ে বলছি, আর কোন জায়গা জানি না তামি। দোহাই আপনাদের, আমাকে ছেড়ে দিন। স্যান ফ্রানসিসকোয় ফিরে যাব, এতক্ষণে হয়তো কান্নাকাটি শুরু করেছে। অ্যানি। আমার সাধ্যমত আমি করেছি, আর কিছু করার নেই।
ভেবে দেখতে হবে, বলল খসখসে গলা, আদৌ ছাড়ব কিনা…ইয়ার্ডের ওই ছেলেটাকে ধরা দরকার। আশপাশের অনেকের সঙ্গে আলাপ করেছি, সবাই একবাক্যে বলেছে, খুব চালু ছোকরা। কম্পিউটারের মত কাজ করে নাকি ওর ব্রেন। বোকার ভান করে থাকে, ওটাও একটা চালাকি। পাথরটা কোথায় নিশ্চয়ই ও জানে।
কিন্তু ওকে ধরি কী করে? ভারি কণ্ঠ। দেখি, একটা উপায় বের করতে হবে। চলো, ওপরে চলো, আলোচনা করি গে।
এই গোপন সিঁড়ি আর ভাঁড়ারটা কেন? যেতে চাইছে না খসখসে গলা। এখানে আরেকবার খুঁজলে হত না? নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানিয়েছে!
আরে, দূর! ওই বুড়োর কাণ্ড! বলল ভারি কণ্ঠ। সিঁড়িটাও সাধারণ, ভাঁড়ারটাও। মদ রাখত, নিরাপদে সংরক্ষণের জন্যেই বোধহয়। বানিয়েছে ভাঁড়ার। তাই না, হ্যারি?
হ্যাঁ, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল হ্যারিসন। মিস্টার অগাস্টের এটা এক খেয়াল। রাতেই শুধু এখানে আসতেন তিনি। প্রায়ই বলতেন, ছেলেবেলা থেকেই বিরাট বাড়িতে বাস করার শখ, যাতে থাকবে গোপন ভাঁড়ার, গোপন অন্ধকার সিঁড়ি।
আজব বুড়ো! বলল ভারি গলা। চলো চলো; এই অন্ধকার, বদ্ধ। বাতাস, দম আটকে আসে!
আলো হারিয়ে গেল ধীরে ধীরে। কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, দড়াম করে দরজা বন্ধ হলো। ভাঁড়ারে একা হয়ে গেল ছেলেরা।
আউফফ! চেপে রাখা শ্বাস ছাড়ল মুসা। আরেকটু হলেই গেছিলাম! যা সব লোক!
শয়তানের চেলা একেকটা! অগাস্ট বলল। হাসি কী! অথচ ওদের দলেরই একজনকে মেরে ফেলল তিন-ফোঁটা।
কী মনে হয়, কিশোর, ওরা কারা? মুসা বলল। এই, কিশোর, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি!
স্বপ্ন থেকে যেন বাস্তবে ফিরে এল কিশোর। অ্যাঁ! …ও, ভাবছিলাম। হ্যারিসনও ওদের দলে! তিন-ফোঁটার বিপক্ষে।
ওসব ভাবাভাবি পরে করলেও চলবে। বেরোনোর উপায় খোজো। আটকা পড়েছি, খেয়াল আছে?
এখানে অপেক্ষা করাই নিরাপদ। এখনও যায়নি ওরা। এসো, ভাঁড়ারটা ঘুরে দেখি।
হয় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এখানে, কিংবা কিশোরের সঙ্গে যেতে হবে। দুটোতেই মুসার অনিচ্ছা। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকাটাই বেশি খারাপ মনে হলো, অগত্যা চলল কিশোরের পিছু পিছু।
উল্টো দিকে আরেকটা দরজা, ঠেলা দিতেই খুলে গেল। বড় চারকোনা আরেকটা ভাঁড়ার, নিচু ছাত, জানালা নেই। দেয়ালের গা ঘেঁষে এক জায়গায় বড় একটা তেলের ট্যাঙ্ক, পাশেই মস্ত একটা তেলের চুলা। ব্যস, আর কিছু নেই।
উল্টো দিকে আরেকটা দরজা, তার ওপাশে সিঁড়ি। নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল কিশোর, সিঁড়ির মাথায় দরজা, নব ধরে মোচড় দিল সে। খুলল না। আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে দেখল, অনড় রইল পাল্লা। কী ভেবে আর খোলার চেষ্টা করল না, নেমে চলে এল।
ওপাশ থেকে ছিটকিনি লাগানো, সঙ্গীদের জানাল কিশোর।
ব্যাপারটার মানে জানা আছে ওদের। দরজা খুলতে না পারলে, এখানেই আটকা থাকতে হবে। বাইরের কেউ জানবে না ওরা কোথায় আছে।
চুপ করে ভাবছে কিশোর। হঠাৎ বলল, যেখান দিয়ে ঢুকেছি ওখান দিয়েই বেরোতে হবে।
কীভাবে? প্রতিবাদ করল অগাস্ট। নবের অর্ধেকটা :লেছে, তালা আটকে গেছে। ওপাশ থেকে ছাড়া খোলা যাবে না। চাবিও নেই আমাদের কাছে।
আমারই দোষ! বিষণ্ণ শোনাল মুসার কণ্ঠ।
এসো, চেষ্টা করে দেখি, খোলে কিনা, কিশোর বলল।
আবার আগের ভাঁড়ারটায় এসে ঢুকল ওরা। দরজার ভাঙা নবের কাছে আলো তুলে ধরল মুসা। কোমরে ঝোলানো সুইস ছুরিটা খুলে নিল। কিশোর, অনেকগুলো ফলা, বিভিন্ন কাজে লাগে, তার খুবই প্রিয়! একটা ফলা খুলল, ছোট একটা স্ত্র-ড্রাইভার এটা।
সাধারণ তালা, ভালমত দেখে বলল কিশোর। খুলতেও পারে। ছোট চারকোনা গর্তে ভ্রু-ড্রাইভার ঢুকিয়ে মোচড় দিল সে। ঘুরল না। যন্ত্রটা আরেকটু ঠেলে দিয়ে আবার মোচড় দিল। ক্লিক করে ঘুরে গেল। তালার জিভ, খুলে গেল।
এত সহজে তালা খুলে গেছে, বিশ্বাসই হচ্ছে না মুসা আর। অগাস্টের।
পাল্লা খুলে উঁকি দিল কিশোর, সিঁড়ির অর্ধেকটা পর্যন্ত আবছা দেখা, যাচ্ছে, তারপরে অন্ধকার। কেউ আছে বলে মনে হলো না।
সিঁড়ির গোড়ায় চলে এল সে। অন্য দুজনকে ডাকল।
হঠাৎ জ্বলে উঠল আলো।
চোখ ধাঁধিয়ে দিল টর্চের আলো, চোখ পিটপিট করছে কিশোর, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
বাহ, এই তো আছে! গমগম করে উঠল ভারি গলা। তাই তো বলি, সাইকেল রেখে গেল কোথায়! এসো, লক্ষ্মী ছেলের মত চুপচাপ উঠে এসো। নইলে…
বারো
কিশোরের ব্যবহারে লক্ষ্মী ছেলের কোন লক্ষণই দেখা গেল না। এক ঝটকায় ঘুরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল দরজার ওপর, হাত বাড়িয়ে নবটা ধরার চেষ্টা করল। পারল না। ধাক্কা লেগে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। পাল্লা।