মেরি চাচীর সঙ্গে কথা বলছেন চাচা। এই-ই সুযোগ, চুপচাপ ওখান থেকে সরে চলে এল তিন গোয়েন্দা, নিজেদের ওয়ার্কশপে এসে ঢুকল।
সামনে লম্বা ছুটি, কী করে কাটাবে, সেই আলোচনায় বসল ওরা।
কী করি? মুসা বলল। চলো, মরুভূমিতে চলে যাই একদিন। পুরানো পোড়ো শহর দেখব।
তার চেয়ে সাবান কোম্পানির প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা। যাক, প্রস্তাব রাখল রবিন। জিততে পারলে হাওয়াই থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।
আমি ভাবছি… কথা শেষ করতে পারল না কিশোর, তার আগেই মাথার ওপরের লাল আলোটা জলতে-নিভতে শুরু করল।
ফোন এসেছে! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
নিশ্চয় কেউ কোন সমস্যায় পড়েছে, উজ্জ্বল হয়ে উঠল কিশোরের চেহারা।
দুই সুড়ঙ্গের পাইপের মুখের ঢাকনা সরিয়ে ফেলেছে মুসা ইতিমধ্যে। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ল তার ভেতর। মোটা একটা গ্যালভানাইজড পাইপকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জঞ্জালে ঢাকা একটা মোবাইল ট্রেলারের তলায়। ট্রেলারের ভেতরে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার।
পাইপের শেষ মাথায় আরেকটা ঢাকনা সরিয়ে ট্রেলারের ভেতর ঢুকল মুসা। তার পেছনে অন্য দুজন।
থাবা দিয়ে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল কিশোর। হালো! কিশোর পাশা। টেলিফোন লাইনের সঙ্গে যুক্ত স্পিকারের সুইচ অন করে দিল।
ধরে থাকো, প্লিজ, ভেসে এল একটা নারীকণ্ঠ। মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার কথা বলবেন।
মিস্টার ক্রিস্টোফার! তার মানে আরেকটা রহস্যময় কেস!
কিশোর, গমগম করে উঠল চিত্রপরিচালকের ভারি কণ্ঠ, ব্যস্ত? আমার সামনে একজন বসে আছে। তোমাদের সাহায্য চায়। করতে পারবে?
নিশ্চয়, স্যর। সানন্দে। কী সাহায্য চায়?
কেউ একজন মূল্যবান কিছু রেখে গেছে তার জন্যে। কী জিনিস, কোথায় আছে, কিছুই জানে না সে। যদি কাল দশটায় আমার অফিসে আসো, ও থাকবে ওখানে।
দুই
দারুণ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। নতুন কেস! সময় কাটবে এবার!
মূল্যবান জিনিস রেখে গেছে! কুটি করল রবিন। কী জিনিস জানে না! কোথায় আছে, তা-ও না! জটিল ব্যাপারই মনে হচ্ছে!
জটিল হলেই তো ভাল, কিশোর বলল। কাজ করে মজা পাওয়া যাবে।
একটা গাড়ি পেলে ভাল হত, আফসোস করল মুসা। এত বড় স্টুডিওতে ওই পুরানো পিকআপ নিয়ে যেতে খারাপ লাগে, ফকির ফকির মনে হয়।
ঠিক আছে, কিশোর বলল, রেন্ট-আ-রাইড অটো রেন্টাল কোম্পানিতে ফোন করছি। রোলস রয়েসটা নিয়ে কাল সকালে হাজির হয়ে যাবে হ্যাঁনসন। ডায়াল শুরু করল সে।
এক সময় বিজ্ঞাপনের বাজি জিতে শোফারসহ একটা গাড়ি তিরিশ দিন ব্যবহারের জন্যে পেয়েছিল কিশোর। বিশাল এক রোলস রয়েস, পুরানো ধাঁচের রাজকীয় গাড়ি, ক্লাসিক্যাল চেহারা। চৌকো, বাক্সের মত দেখতে মূল শরীরটা কুচকুচে কালো। চকচকে পালিশ, মুখ দেখা যায়। মাঝে মাঝে সোনালি রঙের কাজ। প্রকাণ্ড দুটো হেডলাইট।
হালো! বলল কিশোর। ম্যানেজার সাহেব আছেন? প্লিজ, দিন। …ম্যানেজার সাহেব? আমি কিশোর পাশা। আগামীকাল সকাল সাড়ে নটায় রোলস রয়েসটা দরকার, হ্যাঁ হ্যাঁ, শোফারসহ।
অসম্ভব! কণ্ঠ শুনেই বোঝা গেল বিস্মিত হয়েছে ম্যানেজার। তোমার তিরিশ দিন সেই কবেই শেষ হয়ে গেছে।
ঠিক বলেছে, মুসা বলল। আরও কত তিরিশ দিন পেরিয়ে গেছে। দেবে কেন?
মুসার কথায় কানই দিল না কিশোর। ম্যানেজার সাহেব, আপনি বোধহয় ভুল করছেন। আমার হিসেজে তিরিশ দিন পেরোতে এখনও অনেক দেরি।
কী বলছ! মুসা অবাক। ভুল তো তুমিই করেছ!
মুসার দিকে চেয়ে হাত নাড়ল কিশোর, চুপ করার নির্দেশ।
তুমি ভুল করছ, খোকা, দৃঢ় কণ্ঠে বলল ম্যানেজার।
ম্যানেজার সাহেব, কণ্ঠস্বরে ব্যক্তিত্ব ফোঁটাল কিশোর, শিগগিরই অন্য কথা বলবেন। আমি বিশ মিনিটের মধ্যে আসছি, সামনা-সামনি আলোচনা হবে।
আলোচনার কিছু নেই! রুক্ষ হয়ে উঠল ম্যানেজারের কণ্ঠ। আসতে চাইলে এসো, কিন্তু কোন লাভ হবে না।
থ্যাঙ্ক্যু, বলে রিসিভার নামিয়ে রেখে সঙ্গীদের দিকে ফিরল কিশোর। চলো। শহরতলীতে যাব।
কিন্তু ম্যানেজার ঠিকই বলেছে! প্রতিবাদ করল মুসা। তিরিশ দিন সেই কবে শেষ…
সব সময় তিরিশ দিন পেরোলেই তিরিশ দিন হয় না, রহস্যময় শোনাল কিশোরের কণ্ঠ দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনার দিকে এগোল সে।
কিন্তু…
খামোকা তর্ক করছ, মুসা, রবিন বাধা দিল। ও যা ভাল বুঝছে, করুক না। যদি গাড়িটা আবার পাই আমরা, ক্ষতি কী?
সাইকেল নিয়ে ইয়াড থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। সৈকতের ধার ঘেষে চলে গেছে পথ, ঢুকেছে গিয়ে রকি বিচের একেবারে। অভ্যন্তরে। বায়ে উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে গাঢ় নীল প্রশান্ত মহাসাগর। দিগন্তের কাছে অনেকগুলো বিন্দু, সব মাছধরা নৌকা। ডানে আকাশ ফুড়ে উঠে যাওয়ার তাল করছে যেন সান্তা মনিকা পর্বতমালা, রুক্ষ, বাদামী।
প্রধান সড়কের এক মোড়ে রেন্ট-আ-রাইড অটো রেন্টাল কোম্পানির বিশাল অফিস। সাইকেল স্ট্যাণ্ডে তুলে রেখে ভিতরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা, আগে আগে হাঁটছে কিশোর, দ্বিধাজড়িত পায়ে তাকে অনুসরণ করছে মুসা আর রবিন। ওরা ঠিক জানে, বিফল হয়ে ফিরতে হবে।
অফিসেই রয়েছে ম্যানেজার। লাল চেহারা, কড়া মানুষ, সেটা চেহারাতেই স্পষ্ট। তিন গোয়েন্দাকে দেখে ভারি ভুরু কোঁচকাল। গম্ভীর।
তিরিশ দিন গাড়ির ব্যবহারের কথা ছিল, কোনরকম ভূমিকা করল না ম্যানেজার, করেছ। আবার কী চাই? গুনতে জানো না?