রবিনের চমকে ওঠা লক্ষ করলেন মিস হকিনস। কী ব্যাপার, রবিন?
আনমনেই মাথা নাড়ল রবিন। বইটা তুলে নিয়ে এল মহিলার কাছে। এটার জন্যেই এসেছিলাম। টেবিলে পড়ে আছে!
আরে! মিস হকিনসও চোখ কপালে তুললেন। আশ্চর্য! কয়েক বছর ধরে র্যাকে পড়ে আছে ওটা, ছুঁয়েও দেখে না কেউ! আজ একই দিনে দুজনের দরকার পড়ল!
কে পড়ছিল, মনে আছে?
না। আজ এমনিতেই ভিড় বেশি, তা ছাড়া কোন্ টেবিলে কে কী পড়ছে, এখানে বসে কী করে জানব!
বোকার মত প্রশ্ন করে বসেছে সে-ভাবল রবিন। কে হতে পারে?
আচ্ছা, লোকটার কি কালো গোঁফ ছিল? আবার জিজ্ঞেস করল সে। চোখে হর্নরিমড় চশমা? এই মাঝারি উচ্চতা…
হ্যাঁ হ্যাঁ, ওরকম একটা লোক এসেছিল বটে, মাথা ঝাঁকালেন মিস। হকিনস। তবে ও-ই এই বই পড়েছে কিনা…না না, ঠিক, ও-ই পড়েছে! আমাকে এ-ধরনের বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। ফাসফেঁসে গলা, সেজন্যেই মনে করতে পেরেছি। চেনো নাকি ওকে?
না, শুনেছি। বাকি বইগুলো র্যাকে তুলতে চলল সে। মনে ভাবনার ঝড়। কালো-গুফো এই বই পড়ছিল কেন? কী জানতে চেয়েছিল? লোকটা কে?
তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বইটা নিয়ে এসে কোণের দিকে প্রায় নির্জন একটা টেবিলে বসল রবিন।
গভীর আগ্রহে বইয়ের বিশেষ বিশেষ জায়গা পড়ে চলল সে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব রত্ন আবিষ্কারের রোমাঞ্চকর ইতিহাস, বিভিন্ন তথ্য। যেটাই ধরছে, ছাড়তে পারছে না। জোর করে শেষে হোপ হীরার অধ্যায় থেকে চোখ সরাল, পাতা উল্টে চলল। হঠাৎ করেই পেয়ে গেল রক্তচক্ষু, পুরো একটা অধ্যায় লেখা রয়েছে ওটার ওপর।
পায়রার ডিমের সমান একটা পদ্মরাগমণি। কখন, কোথায়, কীভাবে আবিষ্কার হয়েছে ওটা, কেউ জানে না। কিন্তু কয়েক শতাব্দী ধরে পাথরটার নাম জানে চীন, ভারত আর তিব্বতের মানুষ। রাজা-মহারাজা, সম্রাট, রানী, রাজকুমারী, বড় বড় সওদাগর, অনেকেই এর মালিক হয়েছে, কিন্তু কেউ ধরে রাখতে পারেনি বেশিদিন। কারও কাছ থেকে চুরি হয়েছে, কারও কাছ থেকে ছিনতাই, বেশ কয়েকজন খুনও হয়েছে ওটার জন্যে। শুধু তাই নয়, রাজায় রাজায় লড়াই বাধিয়েছে ওই চুনি, সিংহাসন-ছাড়া করেছে রাজাকে, কাঙাল বানিয়ে বনবাসে পাঠিয়েছে। অন্তত পনেরোজনের রহস্যময় মৃত্যু ঘটেছে ওই পাথরের জন্যে।
মহামূল্যবান রক্তচক্ষু; অদ্ভুত নামকরণের কারণ, দেখতে ওটা মানুষের চোখের মত, রঙ রক্তলাল। মহামূল্যবান কেন হলো ওটা, জানা যায়নি, বরং উল্টোটাই হওয়ার কথা। রক্তচক্ষু নিরেট নয়, মস্ত খুত আছে, ভেতরটা ফাপা। তবু এর জন্যে পাগল মানুষ! কেন!
পড়তে পড়তে অধ্যায়ের শেষে চলে এল রবিন লেখা রয়েছে:
মূল্যবান অনেক পাথরই আছে, যেগুলো অভিশপ্ত, দুর্ভাগ্য বয়ে আনে মালিকের। বার বার হাত বদল হয়েছে ওগুলো, কেউ মরেছে, কেউ সাংঘাতিক অসুখে ভুগেছে ওগুলোর জন্যে, কারও বা অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ওগুলোর মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে কেউই নিরাপদ ছিল না। হোপ হীরা ওসব পাথরের একটা, মানুষের ক্ষতি করেই চলছিল, শেষে ভয়ে ওটাকে ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটকে দান করে। দিয়ে বাচল ওটার শেষ মালিক। রক্তচক্ষু ওরকম আরেকটা অভিশপ্ত পাথর। ওটার মালিক হয়ে দুর্ভাগ্যের কবল থেকে বেঁচেছে খুব কম লোকেই। শেষে ওটাকে ভারতের এক মহারাজ দান করে দিলেন ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম কাটিরঙ্গার ন্যায়-বিচারের মন্দির-এ (গ্রাম এবং মন্দিরের নামের ব্যাপারে মতান্তর আছে)।
মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে নিয়োজিত রয়েছে একদল দুর্ধর্ষ পাহাড়ি উপজাতির লোক, ভয়ানক যোদ্ধা ওরা। দেব-মূর্তির কপালে খোচিত ছিল রক্তচক্ষু। স্থানীয় লোকের বিশ্বাস, পাপীকে ধরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে পাথরটার। কাউকে দোষী সন্দেহ হলে, তাকে নিয়ে আসা হত রক্তচক্ষুর সামনে। যাকে আনা হলো, সে পাপী হলে, জ্বলে উঠবে পাথরটা।
অনেক বছর আগে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায় রক্তচক্ষু। এখন কোথায় আছে, কেউ জানে না, অথচ আজও এর আশা ছাড়েনি। মন্দিরের লোক, দুনিয়াময় খুঁজে বেড়াচ্ছে পাথরটা। গুজব রয়েছে, মন্দিরেরই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে পাথরটা বিক্রি করে দিয়েছে বিদেশী কারও কাছে। কেউ বলে পাথরটা এখন অপঘাতে মরা চোরের কবরে পড়ে রয়েছে, তার শুকনো হাড়গোড়ের মাঝে। কেউ বলে, না, কবরে নেই, অন্য জায়গায়, আবার একদিন উদয় হবে। পুরানো কিংবদন্তী বলে: পঞ্চাশ বছর মানুষের ছোঁয়া না পেলে রক্তচক্ষুর ক্ষতি করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে, অভিশাপমুক্ত হয়ে যাবে, তখন কেউ ওটা খুঁজে বের করতে পারলে, উপহার পেলে, কিংবা ন্যায্য দামে কিনে নিলে তার আর ক্ষতি হবে না। তবে, চুরি কিংবা ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া চলবে না, তা হলে যে নেবে তার ক্ষতি হবেই।
কিছু রত্ন-সংগ্রাহক গোপনে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে পাথরটা। অভিশপ্ত হোক বা না হোক, পাথরটা তাদের চাই-ই। তবে ক্ষীণ একটা আশাও রয়েছে ওদের, হয়তো পঞ্চাশ বছরে শুদ্ধ হয়ে গেছে রক্তচক্ষু।
বাপ রে! জোরে নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। ওই পাথরের কাছ থেকে দূরে থাকাই উচিত!-মনে মনে বলল। কী ভেবে পাতা উল্টে বইটা কবে লেখা হয়েছে, দেখে নিল। বেশ কয়েক বছর আগের ছাপা। কয়েকটা প্রশ্ন। ভিড় জমাল মনে। কতদিন আগে চুরি হয়েছে রক্তচক্ষু? সত্যিই ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে পাথরের? তা যদি হয়, পঞ্চাশ বছর পর কি আসলেই শুদ্ধ হয়ে যাবে রক্তচক্ষু।