দেখো, অত্যাচার সব দেশেই আছে। আমেরিকানরা কম অত্যাচার করেছিল চীনাদের ওপর? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসি আর। জাপানীরা কী করেছে? আজও ইহুদীরা যে অত্যাচার চালাচ্ছে। প্যালেসটাইনীদের ওপর, ভাবতেই গা শিউরে ওঠে! আর ইংরেজরা কী করেছিল? অগাস্টের ওপর চোখ পড়তেই থেমে গেল কিশোর। গাস, কিছু মনে কোরো না, আমি ইতিহাসের কথা বলছি। ভারত দখল করেছিল ওরা জোর করে; দুশো বছর ধরে একটানা অকথ্য অত্যাচার, অনাচার চালিয়েছে, বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করেছিল লর্ড ক্লাইভ আর তার চেলারা, ওদের তুলনায় ভারতের মানুষ ফেরেশতা…
হয়েছে, হয়েছে, কিশোর, থামো! দুহাত তুলল মুসা। আমি মাপ চাইছি!
সরি! লজ্জিত হলো কিশোর। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। ইনডিয়াকে কেউ খারাপ বললে সইতে পারি না। ওটা আমার দেশ…
বাংলাদেশ না? অগাস্ট প্রশ্ন করল।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান আগে একটাই দেশ ছিল, ক্লাইভের চেলাদের কাছে ব্লাডি ইনডিয়া, ওরাই ভাঙনের বীজ বুনে এসেছে, ভাগাভাগি করে দিয়ে এসেছে একটা অখণ্ড সোনার দেশকে।…যাক গে, ওসব পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। সব দেশেই ভালমন্দ আছে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম… ফোন বেজে উঠল, বাধা পড়ল তার কথায়।
উঠে গিয়ে রিসিভার তুলে নিল কিশোর। হ্যালো। পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ড।
মিসেস প্যাশা আছেন? মহিলাকণ্ঠ ভেসে এল। আমি ম্যালিবু বিচ থেকে বলছি। মিসেস হ্যামলিন।
তিনি তো নেই, বাইরে গেছেন। জরুরি কিছু? আমাকে বলবেন? চাচী এলেই বলব।
ও, তোমার চাচী? গুড। কী নাম তোমার, খোকা?
কিশোর পাশা। কিশোর।
হ্যাঁ, কিশোর, গতকাল দুটো মূর্তি কিনেছিলাম তোমাদের ওখান। থেকে। বাগানে সাজাব বলে।
সাজিয়েছেন? সতর্ক হয়ে উঠল কিশোর।
না, পারলাম আর কই? ধুলোময়লা খুব বেশি ছিল, বাগানে ফেলে পাইপের পানি দিয়ে ধুতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একেবারে নরম কাদা দিয়ে তৈরি। পয়লা চোটেই কান খসে গেল, তারপর চলটা উঠতে শুরু করল, ওগুলো ঘরে রাখার জিনিস, বাগানে বৃষ্টিতে চব্বিশ ঘণ্টাও টিকবে না। ভাবছি, ফেরত নেবে কিনা! বাগানে তো সাজাতে পারলাম না, তোমার চাচী অবশ্য তাই বলেছিল…
সরি, মিসেস হ্যামলিন, আমরা জানতাম না ওগুলো মাটির। পুরানো জিনিস কিনি তো, কোনটা যে খারাপ পড়বে, ঠিক বোঝা যায় না। আপনি মূর্তি পাঠিয়ে দিন, পয়সা ফেরত নিয়ে যাবেন। আচ্ছা, কার মূর্তি নিয়েছিলেন?
কার মূর্তি মানে?
মূর্তিগুলো তো সব বিখ্যাত লোকের, নামটা জানতে চাইছি।
অ। তা ঠিক বলতে পারব না। তবে পোল্যাণ্ড নামটা মনে আছে, পোল্যাণ্ডের কী যেন?
অগাস্টাস?
হ্যাঁ হ্যাঁ, অগাস্টাস অভ পোল্যাণ্ড। আজব নাম! তা মূর্তিগুলো পাঠিয়ে দিতে বলছ?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে। কাল আমিই নিয়ে আসব।
আপনি আর কেন কষ্ট করবেন? তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। আমরাই বরং আসি, দোষটা তো আমাদেরই, টাকা ফেরত দিয়ে মূর্তি নিয়ে আসব। আজ বিকেলেই আসি?
তা হলে তো খুবই ভাল হয়।
ঠিকানাটা দিন।
ঠিকানা লিখে নিয়ে মিসেস হ্যামলিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিসিভার রেখে দিল কিশোর। ফিরে তাকাল।
কৌতূহলে ফেটে পড়ছে মুসা আর অগাস্ট। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
অগাস্টাস অভ পোল্যাণ্ডকে পাওয়া গেছে, হাসল কিশোর। বোরিস ফিরে এলেই যাব। নিয়ে আসব মূর্তিটা!
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। তিন-ফোঁটার কাছ থেকে খবরটা গোপন রেখো, আল্লাহ!
মুসার কথার ধরনে হেসে ফেলল কিশোর আর অগাস্ট।
সাত
রকি বিচ পাবলিক লাইব্রেরিতে পার্ট-টাইম চাকরি করে রবিন, হাতখরচের টাকাটা এসে যায়, মা-বাবার কাছে চাইতে হয় না; তা ছাড়া, পছন্দসই জিনিস কেনার ব্যাপারও আছে। তবে সবচেয়ে বড় সুবিধে, ইচ্ছেমত যখন-তখন এসে বইপত্র ঘাটাঘাটি করা যায়, লাইব্রেরিয়ানের অনুমতি নিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়, এখানে চাকরি না করলে এই সুবিধেটা পেত না।
অসময়ে রবিনকে লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেখে অবাক হলেন না প্রৌঢ়া। লাইব্রেরিয়ান মিস হকিনস। তবু জিজ্ঞেস করলেন, আরে, রবিন! আজ তো তোমার ডিউটি নেই।
একটা তথ্য দরকার, আপা, রবিন বলল। কয়েকটা বই দেখব।
অ, তাই বলি, অসময়ে আমাদের ছোট গোয়েন্দা এখানে কেন? মিষ্টি করে হাসলেন মিস হকিনস। এসে ভালই করেছ, রবিন। আজ যা কাজ না! একটু সাহায্য করবে? না না, বেশি কিছু না, এই কয়েকটা বই একটু র্যাকে তুলে দেবে। পারবে?
নিশ্চয়, দিন, এগিয়ে এল রবিন।
বইগুলোর অবস্থা দেখে পাঠকদের ওপর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল রবিনের, এত অযত্ন করে! কোনটার মলাট ছিঁড়ে ফেলেছে, কোনটা সেলাই ছিঁড়ে যাওয়ায় ভেতরের পাতা বেরিয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় এগুলো র্যাকে তোলা উচিত হবে না, এরপর টানাটানিতে একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। বেশি ছেঁড়া বইগুলো তুলে নিয়ে হলের পেছনের ছোট একটা ঘরে চলে এল। সুচ-সুতো-ছুরি-কাঁচি-আঠা, সবই আছে এখানে। কাজে লেগে গেল সে। সেলাই করে, আঠা লাগিয়ে, মলাট জুড়ে দিয়ে আবার প্রায় নতুন করে ফেলল সে বইগুলোকে, গভীর মমতায় একবার হাত বোলাল ওগুলোর ওপর, তারপর এনে সাজিয়ে রাখতে লাগল র্যাকে।
বাকি বইগুলো নিয়ে এল রবিন। তূপের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা মোটা বই, নতুনই রয়েছে মলাট। নামটা দেখে চমকে উঠল। সে, ফেমাস জেমস অ্যাণ্ড দেয়ার স্টোরিজ। ঠিক এই ধরনের একটা বই-ই মনে মনে খুঁজছিল সে।