এই পদ্ধতির নাম রেখেছি আমরা ভূত-থেকে-ভূতে, গর্বের সঙ্গে বলল রবিন। সাংঘাতিক নাম। বড়দের সামনে বললেও ক্ষতি নেই, কিছুই বুঝবে না। বড়জোর হাসবে, বলবে, বাচ্চাদের খেয়াল!
তোমরা জিনিয়াস! প্রশংসা না করে পারল না অগাস্ট। কিশোরের দিকে ফিরল। এখুনি ফোন করবে?
আজ শনিবার, মনে করিয়ে দিল কিশোর। বিকেলও হয়ে এসেছে। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই এখন বাইরে। ডিনারের আগে ফোন করে লাভ নেই। কয়েকটা ঘণ্টা অপেক্ষা করতেই হচ্ছে…
কিশোর! মেরি চাচীর ডাকে বাধা পড়ল কথায়। ট্রেলারের ছাতে স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে আসছে শব্দ। এই, কি-শো-র! কোথায় তোরা?
ডেস্ক থেকে মাইক্রোফোন তুলে নিল কিশোর। ছাতে বসানো রয়েছে। ছোট একটা শক্তিশালী স্পিকার, ভেতর থেকে বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এটা ব্যবহার করে সে। আরও বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়। আমি এখানে, চাচী, জবাব দিল সে। দরকার?
ওই দেখো, এবার স্পিকার লাগিয়েছে! জঞ্জালের ভেতর বসে যে কী করে ছেলেগুলো! পাগল হতে আর দেরি নেই! আরে, অই, কিশোর, কটা বেজেছে খেয়াল আছে? পেটের খবর আছে, না নেই? খাবি-টাবি না?
লাঞ্চ! প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। তাই তো! একেবারে ভুলেই গিয়েছিল। অন্য ছেলেদেরও মনে পড়ল খাওয়ার কথা।
আসছি, চাচী, জবাব দিল কিশোর। সঙ্গে মেহমান আছে।
তখনই তো দেখেছি, মেরি চাচী বললেন। ওকেও নিয়ে আয়। মাংসের বড়া ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
কালো পুরু ঠোঁটের ফাঁকে ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়ল মুসার। আঙুল দিয়ে নিজের পেটেই চাটি দিল, তবলা বাজাল যেন। কিশোরের হাতে ধরা মাইক্রোফোনের ওপর ঝুঁকে বলল, বেড়ে ফেলুন। গিয়ে, চাচী! আমরা এই এলাম বলে!
পাগল! মেরি চাচীর সস্নেহ হাসি শোনা গেল।
সবার আগে ঢাকনা তুলে দুই সুড়ঙ্গে নেমে পড়ল মুসা।
রাশেদ চাচা নেই, কী কাজে বাইরে গেছেন। হাতমুখ ধুয়ে এসে টেবিল ঘিরে বসে পড়ল ছেলেরা। মাংসের বড়া, রুটি, ডিমসেদ্ধ, আর কমলার রস দিয়ে লাঞ্চ সারা হলো।
কিশোর, এটো প্লেটগুলো সিঙ্কে ফেলতে ফেলতে বললেন মেরি চাচী, আমি বাইরে বেরোব। রোভার গেছে তোর চাচার সঙ্গে, আমি বোরিসকে নিয়ে যাচ্ছি। ইয়ার্ডেই থাকিস, আমরা না ফিরলে যাসনে। কোথাও।
আচ্ছা, মাথা কাত করল কিশোর।
বেরিয়ে গেলেন মেরি চাচী।
আরেক গেলাস করে কমলার রস ঢেলে নিল ওরা।
কিশোর, গেলাসে চুমুক দিয়ে আবার নামিয়ে রাখল মুসা। মূর্তিটার ভেতরে কী জিনিস আছে?
রক্তচক্ষু।
কিন্তু ওই রক্তচক্ষুটা কী? প্রশ্ন করল রবিন।
ছোট কোন কিছু, তার সামনের গেলাসটা আগে-পিছে করছে কিশোর। নইলে মূর্তির ভেতরে রাখা যেত না। আর এত যত্ন করে যেহেতু লুকানো হয়েছে, নিশ্চয়ই মূল্যবান কিছু। নইলে এত কষ্ট করার কী দরকার ছিল? এখন প্রশ্ন, ওই মূল্যবান জিনিসটা কী? কোন ধরনের রত্ন? যার ঐতিহাসিক মূল্য আছে? তাই হওয়া উচিত। রত্নের নাম রাখার একটা ফ্যাশান ছিল আগে, এই যেমন গ্র্যাণ্ড মোঘল, স্টার অভ ইনডিয়া, পাশা অভ ইজিপ্ট, রক্তচক্ষুও সেরকম কিছু। দূর প্রাচ্যের কোন দেশ থেকে হয়তো ওটা কিনেছিলেন মিস্টার হোরাশিও অগাস্ট, তারপর কোন কারণে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
হুম! বড় করে শ্বাস ফেলল মুসা। তোমার কথা ঠিক হলে…
চুপ! বাধা দিল রবিন। লোক আসছে!
চকচকে একটা সিড্যান গাড়ি, অফিসের বাইরে থামল। ড্রাইভিং সিটে ইউনিফর্ম পরা শোফার। পেছনের দরজা খুলে নামল লম্বা, পাতলা একটা লোক। টেবিলে রাখা অবশিষ্ট পাঁচটা মূর্তির দিকে তাকাল এক পলক।
লোকটার বা হাতে পালিশ করা একটা কালো ছড়ি, অনেক বেতো রোগীর হাতে যেমন থাকে, ভর দিয়ে হাঁটার জন্যে। ছড়ির ডগা দিয়ে আলতো খোঁচা দিল একটা মূর্তিকে, হাত বোলাল ওটার মসৃণ মাথায়। সন্তুষ্ট হতে পারছে না, চেহারাই প্রকাশ করে দিল। আঙুলের ডগায় লেগে যাওয়া ধুলো মুছল রুমালে, তারপর ঘুরল অফিসের দরজার দিকে।
উঠে দাঁড়িয়েছে কিশোর। অন্যেরা যে যার জায়গায় বসে আছে। দরজার দিকে পা বাড়াল সে।
ধোপদুরস্ত পোশাক পরা ঢেঙা লোকটার চামড়া বাদামী, কুচকুচে কালো চুল ছিল এক সময়, এখন ধূসর। আর কপালে তিনটে কালো ফোঁটা।
এই যে, ছেলেরা, চমৎকার ইংরেজি বলে। তিন-ফোঁটা। মূর্তিগুলো, ছড়ি তুলে দেখাল সে, চুপ করে গেল কিশোরকে তার কপালের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে।
মাত্র এক মুহূর্ত, তারপরই বদলে গেল কিশোরের চেহারা। ঝুলে। পড়ল নিচের ঠোঁট, গাল ফুলে গেল, সামান্য কুঁজো হয়ে গেল পিঠ। হ্যাঁ, স্যর, বলুন? বকের মত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে গলা, আমূল বদলে গেছে কণ্ঠস্বর। বোকা বোকা একটা ভাব।
এগুলো ছাড়া আর আছে? কেমন যেন শীতল কণ্ঠ লোকটার, মনে। হয় দূর থেকে আসছে।
আরও? বুঝতে পারছে না যেন কিশোর।
হ্যাঁ, আরও মূর্তি? থাকলে দেখাও। জর্জ ওয়াশিংটন আর বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনকে দিয়ে চলবে না আমার। অন্য কাউকে দরকার।
এই-ই আছে, কিশোর বলল। বাকিগুলো বিক্রি হয়ে গেছে।
আরও ছিল তা হলে? কালো চোখের তারা ক্ষণিকের জন্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল লোকটার। নাম বলতে পারবে?
নাম…নাম! মনে করার জন্যে চোখ বুজল কিশোর, আস্তে আস্তে মাথা নাড়ছে। চোখ মেলল। অদ্ভুত সব নাম! হোম…হোম…হোমার কী যেন! আগাস, হ্যাঁ হ্যাঁ, আগাসটুস জানি কোন জায়গার!