সাপের মসৃণ পেটে আঙুল চালিয়ে দেখল কিশোর, যতভাবে সম্ভব পরীক্ষা করল। গতকাল গাড়িতে এটা ছিল আপনার সঙ্গে?
ছিল, পরেছিলাম। গতকালই তো? হ্যাঁ, অথচ মনে হচ্ছে অনেক দিন আগের কথা, চোখ মুদলেন। কী করে যে খুলে এল চাকাটা!
চাকা খুলে এল? গাড়ির ভেতরে তা হলে গোলমাল ছিল না?
আবার চোখ খুললেন মিস পল। না…চাকাটা খুলে গেল, সামনের…। গড়াতে গড়াতে ছুটল, পরিষ্কার দেখলাম! সামনে পুল…তারপর আর কিছু মনে নেই…
দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকাল কিশোর। নার্স। কড়া দৃষ্টি।
যাচ্ছি, অনুনয়ের সুরে নার্সকে বলল কিশোর। ব্রেসলেটটা মিস পলের হাতে গুঁজে দিয়ে রওনা হলো দরজার দিকে।
এতক্ষণ জ্বালাবে জানলে ঢুকতে দিতাম না, কঠোর গলায় বলল নার্স।
সরি, করুণ হাসি হাসল কিশোর। যেতে মন চাইছে না…
বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল নার্স। ঠিক আছে, ঠিক আছে, অন্য সময় এসে কথা বোলো আবার, তাড়াতাড়ি বলল সে, আশঙ্কা, ছেলেটা আবার না কেঁদে ফেলে!
চেহারা বিষণ্ণ করে নার্সকে দেখিয়ে দেখিয়ে লিফটে উঠল কিশোর, দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই আয়নার দিকে চেয়ে দরাজ হাসি হাসল নীরবে।
কিছু জানলে? কিশোর কাছে আসতেই জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে। দিল মুসা।
অনেক কিছু, গাড়িতে উঠল কিশোর। সাপটা মহিলার ব্যাগেই রয়েছে।
সা-প! চেঁচিয়ে উঠল বোরিস। হাসপাতালে সাপ সঙ্গে রেখেছে?
ধাতুর সাপ। একটা ব্রেসলেট, গোখরোর হুবহু নকল।
বুঝেছি, আস্তে মাথা দোলাল মুসা। যত গোলমাল এই ব্রেসলেটেই! কোন মাদক ছিল, গাড়ি চালানোর সময় ঢুকে গেছে মিস পলের শরীরে। বরজিয়া আঙটির কথা শোনোনি? গোপন কুঠুরি ছিল আঙটির ভেতরে, তার ভেতরে রাখা হত মারাত্মক বিষ। গোপন অতি সূক্ষ্ম একটা সূচ লাগানো ছিল, ওটা বিষ ইনজেক্ট করে দিত যে পরত তার শরীরে…।
জানি, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। সেজন্যেই ভালমত পরীক্ষা করে দেখেছি ব্রেসলেটটা। বরজিয়া আঙটির মত ভেতরে কোন কৌশল। নেই। চেহারা বাদ দিলে অতি সাধারণ একটা অলঙ্কার, ভ্যারাড নিজে দিয়েছে মিস পলের হাতে। কোন জ্যান্ত সাপ ছিল না মহিলার গাড়িতে, সামনের একটার চাকা হঠাৎ খুলে গিয়েছিল। মুসার দিকে ফিরল সে। কী মনে হয়? ব্রেসলেটে খুলেছে চাকাটা? যদি প্রমাণ করতে পারো, রাশেদ চাচার সব কটা লোহার চুলো চিবিয়ে খাব আমি, কসম।
এগারো
ইয়ার্ডে ফিরে সোজা হেডকোয়ার্টারে রওনা হলো মুসা আর কিশোর। ওয়ার্কশপে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছাপার মেশিনের ওপরে চালায় লাগানো লাইটটা জ্বলছে-নিভছে। তার মানে হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন বাজছে।
জিনা হবে, কিশোর বলল। তাকে আমাদের নাম্বারটা দিয়েছি।
দুই সুড়ঙ্গের মুখে রাখা ধাতব পাতটা সরিয়ে পাইপে ঢুকে পড়ল মুসা। হামাগুড়ি দিয়ে এসে পড়ল শেষ মাথায়, ঢাকনা তুলে উঠে এল ট্রেলারের ভেতরে।
কিশোর ঢাকনা তুলেই শুনল মুসার গলা: …সাপ সত্যিই পাঠানো হয়েছে, তবে নকল সাপ। একটা ব্রেসলেট। …না না, সাপে কিছু করেনি। সামনের চাকা খুলে গিয়েছিল। স্রেফ দুর্ঘটনা…কিন্তু মাত্র পৌঁছেছি আমরা, এখুনি…ঠিক আছে, ডিনারের পর যাব।
রিসিভার নামিয়ে রেখে কিশোরের দিকে ফিরল মুসা। জিনা। মিস। মারভেল আর ভ্যারাড লাইব্রেরিতে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। ফোর্ড গেছে বাজারে। আগে কোথায় চাকরি করেছে, তাকে জিজ্ঞেস করেছিল জিনা। দুজায়গার কথা বলেছে। মিসেস জেরিনাল নামে এক মহিলার বাড়িতে, আর জনৈক প্রফেসর হ্যারিডানের বাড়িতে। মিস্টার জেরিনাল সরকারি চাকুরে, কানসাস সিটিতে বদলী হয়ে গেছেন। ওখানে ফোন করার চেষ্টা করেছে জিনা, পারেনি, ফোন গাইডে নামই নেই। প্রফেসর হ্যারিডানকেও পায়নি, লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।
সুবিধের মনে হচ্ছে না, কিশোর বলল। লোকটাকে কাজ দেয়ার আগে ভালমত খোঁজখবর নেয়া উচিত ছিল।
নেয়নি, এখন সেটা নিতে বলছে আমাদেরকে। কায়দা করে–ফোর্ডের বাসার ঠিকানা জেনে নিয়েছে জিনা, সান্তা মনিকার নর্থ টেনিসনে। এখুনি যেতে বলেছিল, মানা করে দিয়েছি।
ডিনারের পর যাবে বলেছ।
হ্যাঁ। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। এখুনি বাড়ি না গেলে মা আর ঢুকতেই দেবে না।
ডিনারের পরই ভাল। আমারও তখন কোন কাজ থাকবে না।
কিন্তু, গলা চুলকাঁচ্ছে মুসা। জিনার কথায় বড় বেশি নাচছি না আমরা! ও বলল চিলে কান নিল, আর অমনি চিলের পেছনে ছুটলাম!
ও আমাদের মক্কেল, কিশোর যুক্তি দেখাল। ওভাবে ফোর্ডকে ঘরে জায়গা দিয়ে ভুল করেছে, কিন্তু ভুল তো করেই মানুষ। যাই হোক, এখন ওকে সাহায্য করতে হবে আমাদের। হ্যাঁ, রবিনকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি, ঠিক সাতটায় যেন সুপারমার্কেটের সামনের রাস্তায় থাকে। তুমিও ওখানেই এসো। নাকি?
আচ্ছা।
ঠিক সাতটা, দেরি কোরো না।
সন্ধে সাতটা পাঁচ মিনিটে কোস্ট হাইওয়ে ধরে সান্তা মনিকার দিকে সাইকেল চালাল তিন গোয়েন্দা। সঙ্গে আনা ম্যাপ দেখে নর্থ টেনিসন প্লেস খুঁজে বের করল কিশোর। মূল সড়ক থেকে বেরিয়ে গেছে একটা সরু গলি, তার মাথায় একটা বড় পুরানো বাড়ি, লাল টালির ছাত। জিনার দেয়া নাম্বার মিলিয়ে দেখে নিল মুসা।
গ্যারাজ অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়িটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। তোমরা এখানে দাঁড়াও, আমি আসছি। সরু গাড়িপথ ধরে এগিয়ে। গেল সে, ফিরে এল খানিক পরে। একটা ডবল গ্যারাজের ওপর। আরেকটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে। একই নম্বর।