নিঃশব্দে নেমে এল ওরা স্তূপের ওপর থেকে। নরম বালি মাড়িয়ে কুঁজো হয়ে ছুটল। বড় পাথরগুলোর কাছে এসে আস্তে করে উঁকি দিল। বড় জোর ছয় কদম দূরেই রয়েছে ওরা। পায়ের ওপর পা রেখে আরাম করে বসে একটা টিন থেকে কি নিয়ে খাচ্ছে হ্যামার। কিশোর আর মুসা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তেমনি পড়ে রয়েছে। মাটিতে। সিডনি বারভুকে দেখা যাচ্ছে না।
পিস্তল নিশানা করল ওমর। হেঁকে বলল, হাত দুটো তোলো, মিস্টার হ্যামার। শয়তানী করলেই খুলি উড়িয়ে দেব। সন্দেহ থাকলে চেষ্টা করে দেখতে পারো। ববের দিকে ফিরে নিচু গলায় বলল, যাও।
ফিরে তাকাল হ্যামার, এতোই অবাক হয়েছে, হাস্যকর দেখাচ্ছে তার গরিলার মত মুখটা। কোনরকম শয়তানীর চেষ্টা করল না সে। হাত থেকে টিনটা ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে মাথার উপর তুলল দুই হাত।
শান্ত পায়ে হেঁটে গিয়ে হ্যামারের মাথার পেছনে পিস্তল ঠেকাল ওমর। শান্ত থাকো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বারডুকে খুঁজল। নেই। তাকাল ববের দিকে, মুসার বাঁধন কাটা সারা, কিশোরের বাঁধন কাটছে দ্রুত হাতে।
মুক্ত হয়েও দাঁড়াতে পারল না কিশোর। গোড়ালি ডলছে, ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেছে মুখ।
কঠিন হয়ে গেল ওমরের মুখ। বব। এদিকে এসো।
দৌড়ে এল বব।
পিস্তলটা ধরো, বলল ওমর। ব্যাটা একটু নড়লেই দেবে ট্রিগার টিপে। ববের হাতে পিস্তল ধরিয়ে দিয়ে হ্যামারের পকেট হাতড়াতে শুরু করল সে।
একটা রিভলভার পাওয়া গেল, বাঁ হাতে নিল সেটা। দরকার নেই, তবু কি ভেবে নকল ম্যাপটা বের করে নিজের পকেটে রাখল। তারপর উঠে গেল মুসা আর কিশোরের কাছে। কিশোর তো পারছেই না, মুসাও দাঁড়াতে পারছে না ঠিকমত, কব্জি আর গোড়ালি উলছে। দীর্ঘ সময় রক্ত চলাচল ব্যাহত হওয়ায় সাংঘাতিক ফুলে। উঠেছে জায়গাগুলো। ওদের ঠিক হতে আরও কয়েক মিনিট লাগবে।
ঠিক আছে, বসো, হাত তুলে বলল ওমর। ভালমত ডলো। বেশি দূর না, ডিঙিটার কাছে যদি যেতে পারো, তাহলেই চলবে। জানিও, কখন পারবে।
বিমানটা দখল করবেন আবার, না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
নিশ্চয়ই, সঙ্গে সঙ্গে বলল ওমর। আমাদের জিনিস… থেমে গেল সে! ঝন্টু করে মাথা ফেরাল বিমানটার দিকে।
স্টার্ট নিয়েছে উভচরের ইঞ্জিন। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল প্রবাল প্রাচীরের দিকে। এক পাশের খোলা মুখ দিয়ে বেরিয়ে চলে যাবে খোলা সাগরে। জানে লাভ নেই, তবু দৌড় দিল ওমর। কিন্তু দশ পা এগোতে এগোতেই গতি বেড়ে গেল বিমানের, পানিতে ঢেউ তুলে ছুটে গেল দ্রুত গতিতে।
বন্ধুদের কাছে ফিরে এল ওমর। তিক্ত কণ্ঠে বলল, বারডু হারামজাদা। একবারও ভাবিনি ও প্লেনে উঠে বসে আছে।
শূন্যে উঠল উভচর। উফুল্ল চোখে সেটার দিকে চেয়ে রইল হ্যামার।
রেগে গেল ওমর আরও। চোখের পাতা কাছাকাছি হলো। দাঁড়াও, শয়তানের বাচ্চা, তোমার নিজের ওষুধই তোমাকে দেব। আশা করি অসুবিধে হবে না, প্রতিহিংসায় জ্বলজ্বল করছে বেদুঈনের চোখ। মুসা, উঠতে পারবে? দড়ি দিয়ে ব্যাটার হাত-পা বাধো কষে।
হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল মুসা। ও-কে, বস্।
বব, বলল ওমর, যাও তো, স্তূপের চূড়ায় উঠে দেখো, ইমেট চাব আসছে কিনা। পিস্তলটা কিশোরের হাতে দাও, গরিলার বাচ্চা বাধা দিলেই দেবে গুলি মেরে।
কিশোরের হাতে পিস্তল দিয়ে স্তূপের দিকে দৌড়ে গেল বব। ওপরে উঠে একবার চেয়েই ছুটে ফিরে এল। আসছে! আসছে!
ফিরে চাইল ওমর। কত দূরে?
একশো গজ হবে। খুব আস্তে আস্তে আসছে, ম্যাবরিকে নিয়ে আসতে হচ্ছে তো।
দ্রুত চিন্তা চলেছে ওমরের মাথায়। সবাই তৈরি হয়ে যাও। পালাতে হবে আমাদের।
ভুরু কোঁচকাল মুসা। ইমেটের ভয়ে পালাব?
হ্যাঁ, বলল ওমর, অহেতুক ঝুঁকি নিতে যাব কেন? রিভলভারে হাত খুব ভাল ওর। ওর মুখোমুখি হওয়ার যোগ্যতা নেই আমার, অন্তত রিভলভার নিয়ে। গুলি খেয়ে না মরলেও আহত হতে পারি, আমাদের যে কেউ। এই বিজন অঞ্চলে তখন আরও বিপদে পড়ব, ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই। চলো, ভাগি। জলদি করো।
পাথরের স্তূপের দিকে তাকাল কিশোর, পেছনে ঘন বনের দিকে চাইল। ওমরের দিকে ফিরে বলল, যাব কোন দিক দিয়ে?
ওদিক, সাগরের দিকে হাত তুলল ওমর। বব, মুসা, জলদি গিয়ে ডিঙি নামাও পানিতে। কিশোর, এদিকে এসো, আমাদের জিনিস আমরা নিয়ে যাই। প্রথমেই খাবারের টিনগুলো এক জায়গায় জড়ো করতে শুরু করল সে।
ওমর আর কিশোর মিলে খাবারের টিন বয়ে এনে তুলতে লাগল নৌকায়। সব তুলতে পারল না, তবে যত বেশি পারল, তুলল। কিশোর উঠে পড়ল। ডিঙিটা গভীর পানির দিকে ঠেলে দিয়ে আলগোছে লাফিয়ে উঠে বসল ওমর। পানি থেকে বড়জোর ইঞ্চি দুই ওপরে রয়েছে ডিঙির কানা, তবে এখন সাগর শান্ত, আরোহীরা বেশি নড়াচড়া না করলে ডুববে না নৌকা।
ভেবেছ পার পেয়ে যাবে, চেঁচিয়ে বলল হ্যামার। এত সহজ না। দেখাব। মজা।
আমরা অপেক্ষায় থাকব, চেঁচিয়ে জবাব দিল ওমর, বৈঠা তুলে নিয়ে ঝপাং করে ফেলল পানিতে।
ইমেট, এই, ইমেট! চেঁচামেচি শুরু করল হ্যামার। কোথায় তুমি? জলদি এসো। ব্যাটারা পালাল!
পাথরের স্তূপের ওপাশ থেকে সাড়া দিল ইমেট চাব।
শান্ত থাকবে, সঙ্গীদেরকে হুঁশিয়ার করল ওমর, ইমেট চাব গুলি চালালেও নড়বে না কেউ। নড়াচড়ায় ডিঙি ডুবে গেলে আর রক্ষে থাকবে না।
স্তূপের মাথায় দেখা গেল ইমেট চাবকে, প্রায় একশো গজ দূরে চলে এসেছে। ততক্ষণে ডিঙি।