আবার কঙ্কাল দুটোর দিকে তাকাল সে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে। কারা ওরা? বাড়ি কোথায়? কি কারণে এসেছিল, এখানে? কোন দিনই জানবে না হয়তো, জানবে না কেউই। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ঘুরে এগোল সিঁড়ির দিকে। মাঝপথে থেমে কি ভাবল, তারপর ফিরল কাপড়ের স্তূপের দিকে। প্রায় উলঙ্গ হয়ে রয়েছে সে। কাপড় যখন আছে, কেন পরবে না? বাইরে বেরোলেই হয়তো হেঁকে ধরবে মশার পাল, খালি গায়ে থাকলে অতিষ্ঠ করে ফেলবে।
বেছে বেছে একটা ফতুয়ার মত পোশাক তুলে নিল সে, বুকের কাছে সুতোর দড়ির জালি। লালচে একটা পাজামা নিল, আর একটা ছিট কাপড়ের রুমাল। পুরানো, নোনা গন্ধ, কিন্তু গন্ধটা আপাতত সহ্য করল ওমর। খোলা বাতাস আর রোদ লাগলে চলে যাবে গন্ধ, আঠা আঠা ভাবটাও থাকবে না। আর তেমন বুঝলে ধুয়ে নিতে পারবে যখন-তখন। কাপড় যখন পাওয়া গেছে, খালি গায়ে থাকার কোন মানে হয় না।
কাপড়গুলো পরে নিয়ে খুঁজে খুঁজে পায়ের মাপমত একজোড়া বুট বের করল। একটা টুকরো তারপুলিনও পাওয়া গেল। ওমরের মুখে ফুটেছে অদ্ভুত হাসি। একটা পিস্তল তুলে নিয়ে পরীক্ষা করল, ঠিকই আছে মেকানিজম। কয়েকবার স্লাইড টেনে ট্রিগার টিপে হ্যামারের আঘাত দেখল, নাহ, গুলি ফাটাতে পারবে মনে হচ্ছে। কিছু গুলি নিল। বারুদ রাখার বিশেষ বোতলে ভর্তি করে নিল বারুদ। এক সময় নরম চামড়া দিয়ে তৈরি হয়েছিল বোতলটা, এখন লোহার মত শক্ত হয়ে গেছে, তবে কাজ চলবে। আর কিছু নেয়ার আছে? আছে, তবে তারপুলিনে বাঁধতে হবে না। পিস্তল, গুলি, জুতো আর বারুদের বোতল তারপুলিনে রেখে কোনাগুলো এক করে পোঁটলা বাঁধল। কঙ্কালের হাতের কাছে পড়ে থাকা ভোজালিটা নিয়ে গুজল কোমরে। তারপর পোঁটলাটা হাতে ঝুলিয়ে পা বাড়াল আবার সিঁড়ির দিকে। মুখে হাসি।
বাইরে বেরিয়ে দেখল, অনেক নেমে গেছে পানি। খুব সহজেই পেরোতে পারবে এখন প্রণালী। সুবিধামত একটা দিক খুঁজে বের করল। নিচু একটা দেয়াল ডিঙিয়ে যেতে হবে। পেরিয়ে এল সহজেই। পানিতে নামল।
চিত-সাঁতার দিয়ে এগুলো ওমর, দুহাতে উঁচু করে ধরে রেখেছে পোঁটলাটা, যাতে পানি না লাগে। সহজেই পেরিয়ে এল প্রণালী, পোটলা ভিজল না। তীরে উঠে পরনের কাপড় খুলে চিপে পানি ঝরিয়ে নিয়ে আবার পরল।
চাঁদ উঁকি দিচ্ছে দিগন্তে। চারদিক বড় বেশি নীরব, শান্ত। বনের দিকে তাকাল। কি বিপদ লুকিয়ে রয়েছে ওই গাছের দঙ্গলের মধ্যে? জানে না। সাবধান থাকা দরকার। পোটলা খুলে আগে গুলি আর বারুদ ঠাসল পিস্তলে। বুট পরে পাজামার নিচের দিকটা গুঁজে দিল বুটের ভেতর। তারপুলিন দিয়ে বোতলটা বেঁধে নিল কোমরের সঙ্গে। তারপর পিস্তল আর ভোজালি হাতে চলল শেওলায় ঢাকা পাথরটা খুঁজতে, যেটার ওপর নামতে চেয়েছিল কিশোর আর মুসা।
পাথরটার আশপাশ খুঁজল ওমর। বালিতে পড়ে থাকা ববের জ্যাকেটটা দেখতে পেল। কিন্তু কাউকে চোখে পড়ল না। এগিয়ে চলল আবার এক দিকে। খানিক দূরে এগোনোর পর সামনে দেখতে পেল পাথরের তূপ। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে দেখল। ভাবল, ওদিকে যেতে পারবে না মুসা কিংবা কিশোর, আবার ফিরল সে। ফিরে এল সৈকতে, যেখানে উঠেছিল প্রথমে। একটু খোঁজাখুঁজি করতেই কয়েকটা নারকেল পেয়ে গেল, ঝড়ে গাছ থেকে খসে পড়েছিল সাগরে, ঢেউ আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেছে তীরে। ভোজালি দিয়ে নারকেল কেটে আগে পানি খেল, তারপর ধীরেসুস্থে খেল ভেতরের নরম মিষ্টি শাঁস। পেটে কিছু পড়তেই ক্লান্তি এসে চেপে ধরল। চিত হয়ে ওখানেই শুয়ে পড়ল সে।
কিন্তু এত ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম এল না চোখে। ভাবছে। কি হলো ছেলে দুটোর? বেঁচে আছে ওরা? নানারকম দুশ্চিন্তা এসে ভিড় করল মনে। ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়।
তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার কানে আসতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল ওমর। চোখ মিটমিট করছে, কোথায় আছে বুঝতে পারছে না। দুয়েক সেকেণ্ড লাগল পূর্ণ সচেতনতা ফিরে আসতে। একটা শব্দ সে শুনেছে নিশ্চয়ই, কিসের শব্দ? এদিক ওদিক তাকাল, দৃষ্টি আটকে গেল পঞ্চাশ গজ দূরে। পাহাড়ের ওপরে উবু হয়ে বসে কি যেন তোলার চেষ্টা করছে বিশালদেহী এক নিগ্রো। কৌতূহল হলো, উঠে পায়ে পায়ে এগোেল সেদিকে ওমর।
একটা ছেলেকে তুলে আনল নিগ্রো, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না ওমর। বব! নিগ্রোর হাতে কি যেন চকচক করছে। চকিতে মনে পড়ে গেল ওমরের, ক্ষুর, ম্যাবরি। ছুটল সে নিঃশব্দে।
দশ গজ দূরে থাকতে থমকে দাঁড়াল ওমর। আর দেরি করা যায় না। পিস্তল তুলে নিশানা ঠিক করে দিল ট্রিগার টিপে। গুলি ফুটবে কিনা, অনিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু। ফুটল গুলি।
আবার দৌড় দিল ওমর। ছুটতে ছুটতেই দেখল টলে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ম্যাবরি।
চার
ঝুঁকে ববের হাত ধরে তাকে টেনে তুলল ওমর। লেগেছে কোথাও? …ইস, বড় সময়মত এসে পড়েছিলাম, আরেকটু দেরি করলেই…
মাথা ঝোকাল বব। কথা বলতে পারছে না।
পুব আকাশ লাল হয়ে আসছে।
হাঁটু ভেঙে পড়ে যাচ্ছে বব, তার কাধ চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল ওমর, আরে, কি করছ? মূৰ্ছা যাওয়ার সময় হলো এটা? …সোজা, সোজা হও।
মলিন হাসি হাসল বব। সরি। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। পা কাঁপছে। বাঁচব ভাবিনি।
হ্যাঁ, মস্ত ফঁড়া গেছে, বলল ওমর। চোখ পড়ল একটা জিনিসের দিকে।