ঢেউ সরে যেতেই পাথর ছেড়ে দিল ওমর, বুক সমান পানিতে এখন সে, টান পুরোপুরি কমেনি। আবার হাত-পা ছুঁড়ে অবশেষে উঠে এল উপদ্বীপে। পাথর ধরে ধরে উঠল ওপরে, ঢেউয়ের নাগালের বাইরে এসে ধপাস করে শুয়ে পড়ল। ক্লান্তিতে অবশ হয়ে গেছে শরীর।
কয়েক মিনিট চুপচাপ পড়ে রইল ওমর। জিরিয়ে নিয়ে উঠে বসে তাকাল। উপদ্বীপে সাগরের দিকটায় উঠেছে সে। উঠতে শুরু করল চূড়ায়, ওখান থেকে দেখা যাবে মূল দ্বীপটা, মুসা আর কিশোরকে দেখতে পাওয়ার আশাও করছে।
কিন্তু চূড়ায় পৌঁছার আগেই অবাক হতে হলো তাকে। হঠাৎ আবিষ্কার করল, যে পাথর ধরে ধরে উঠে যাচ্ছে সে, ওগুলোতে মানুষের অস্ত্র লেগেছে। বড় পাথর কেটে ছোট ছোট বিভিন্ন আকারের টুকরো করে সেগুলো দিয়ে একটা বুরুজ মত বানানো হয়েছে। বুরুজের ওপরে ওঠার পথ খুঁজে বের করল সে। উঠে এল। অবাক হয়ে দেখল, পুরানো আমলের একটা দুর্গের ভাঙা চত্বরে উঠে এসেছে। গোটা ছয়েক পুরানো কামানও বসানো রয়েছে, কয়েকটা সাগরের দিকে মুখ করা, কয়েকটা ডাঙার দিকে। কাঠের বড় বারকোশে জমিয়ে রাখা হয়েছে বড় বড় গোলা, কামানের গোলা। দুৰ্গটা তৈরি হয়েছিল নিশ্চয়ই সেই আমলে, যখন বাক্যানিয়ারদের সঙ্গে স্প্যানিশদের যুদ্ধ চলছিল।
চত্বরের এক ধার থেকে ধাপে ধাপে নেমে গেছে সিঁড়ি, পাহাড়ের ভেতরে ঢুকেছে। ভেতরে কি আছে, দেখার কৌতূহল হচ্ছে বটে, কিন্তু দেখতে যাওয়ার সময় এটা নয়। উঠে এল একেবারে চূড়ায়, এখান থেকে মূল দ্বীপ দেখা যায়। সৈকত দেখা যাচ্ছে, কিন্তু যতদূর চোখ যায় জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। মুসা আর কিশোরের কি হলো? নিচে তাকাল ওমর। দ্বীপ আর উপদ্বীপের মাঝের সরু প্রণালীতে এখন উথাল-পাতাল ঢেউ, ভীষণ অবস্থা। এখন ওটা সাঁতরে পেরোনোর চেষ্টা আত্মহত্যার সামিল। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
মন খারাপ হয়ে গেছে ওমরের। ববকে হারিয়েছে, কোন সন্দেহ নেই। মুসা আর কিশোরের কি হয়েছে, বুঝতে পারছে না। দুদুটো বিমান হারিয়ে সে আটকা পড়েছে এক দ্বীপে, সঙ্গে খাবার নেই, পানি নেই, অস্ত্র নেই।
আলো কমছে দ্রুত, শিগগিরই অন্ধকার হয়ে যাবে। ঝড় থেমেছে, কিন্তু সাগরের ফোঁস ফোঁস বন্ধ হয়নি। প্রণালীটা সাঁতরে পেরোনোর সময় হয়নি এখনও, দেরি আছে। দিগন্তে হঠাৎ হঠাৎ করে উদয় হলো সূর্য, কালো মেঘের ফাঁকে। লালচে আলো ছড়িয়ে পড়ল মূল দ্বীপের চন্দ্রাকৃতি মাথায়, রাঙিয়ে লাল করে দিল। অপরূপ দৃশ্য। কিন্তু দেখার মন নেই ওমরের। সে ভাবছে কিশোর আর মুসার কথা। কি হলো ওদের? বেঁচে আছে তো? নাকি ববের মত তাদেরকেও নিয়ে গেছে। উন্মত্ত সাগর?
খামোকা বসে থাকার চেয়ে আশপাশটা ঘুরে দেখা উচিত মনে করল ওমর। যেখানে বসে আছে, ওখান দিয়ে নামতে পারবে না প্রণালীতে, খাড়া পাহাড়। ঢালু জায়গা বের করতে হবে। নেমে চলে এল আরেক দিকে। আরে, সিঁড়ি যে একেবারে তৈরিই করে রেখেছে। মালপত্র নিয়ে জাহাজ আসত, সেসব মালপত্র তোলার জন্যেই তৈরি হয়েছিল এই সিঁড়ি। হঠাৎই মনে পড়ল তার, পানি। নিশ্চয়ই পানি রাখার ব্যবস্থা আছে কোথাও দুর্গে। এসব পাথুরে জায়গায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্যে ট্যাংক খোঁড়া হয় পাথরের তলায়, একটা বা বেশ কয়েকটা নালা কেটে পথ। করে দেয়া হয়, সেই পথ দিয়ে গিয়ে বৃষ্টির পানি জমা হয় ট্যাংকে। পানির কথা মনে হতেই তৃষ্ণা টের পেল সে, এতক্ষণে খেয়াল করল, নোনা পানি শুকিয়ে চড়চড় করছে মুখ। ঠিক আছে, আগে পানির খোঁজই করবে। আবার সেই চত্বরে চলে এল সে, যেখানে কামানগুলো রয়েছে, যেখানে একপ্রান্ত থেকে সিঁড়ি নেমে ঢুকেছে পাহাড়ের গভীরে।
সিঁড়ি বেয়ে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল সে। যতই নামছে, বাড়ছে অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। খুব সাবধানে এক পা এক পা করে বাড়িয়ে দিয়ে নেমে চলল। যতক্ষণ সিঁড়ি আছে, নামবে, তারপর কিছু না পেলে ফিরে উঠে আসবে। কিন্তু আরও কয়েক ধাপ এগোতেই আলো চোখে পড়ল। খুব কায়দা করে। সুড়ঙ্গ কেটে আলো আনার ব্যবস্থা হয়েছে। আলো আনার জন্যেই, নাকি অন্য কোন ব্যাপার? যা-ই হোক, পরে দেখা যাবে। আপাতত বড় একটা কামরায় এসে ঢুকেছে সে। পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে এই পাতালকক্ষ। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ওমরের। অদ্ভুত এক অনুভূতি। লাফ দিয়ে কয়েকশো বছর পেরিয়ে অতীতে চলে এসেছে যেন। সে। আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে ঘরের ভেতরটা।
অনুমান করল ওমর, চল্লিশ ফুট চওড়া আর চল্লিশ ফুট প্রশস্ত হবে কামরাটা। ঘরের জিনিসপত্রের অবস্থা দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না, কোন কারণে খুব তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়েছিল এর অধিবাসীরা, সোজা কথা, পালিয়েছিল। পুরানো আমলের একগাদা কাপড় তূপ হয়ে পড়ে আছে এক কোণে। লুপহোলে আটকানো একটা তামার সুইভেল-গানের ওপর পড়ে আছে কিছু কাপড়। এক দিকের দেয়াল। ঘেষে কুঁকড়ে পড়ে রয়েছে দুটো কঙ্কাল, পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় খুব কষ্ট পেয়ে মরেছিল। একটা কঙ্কালের হাতের আঙুলের কাছে পড়ে রয়েছে মস্ত এক ভোজালি। মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা পিস্তল আর মাসকেট বন্দুক। আর আছে ছটা পিপে। দেখা গেল, চারটে পিপেতে খাবার ছিল-তিনটেতে মাংস, শুকনো হাড়গুলো শুধু অবশিষ্ট রয়েছে, আরেকটাতে ময়দা-নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি দুটোতে ছিল বারুদ, কিছু তলানি এখনও আছে। ঘরের আরেক কোণে ধুলোয় ঢাকা পড়ে আছে ছোট গোল মার্বেলের মত কিছুর তৃপ। এক মুঠো হাতে নিয়েই আবার ফেলে দিল ওমর। ওজনেই বোঝা গেছে কি জিনিস। গুলি। মাসকেটের হতে পারে, কিংবা সুইভেল-গানের। কিন্তু পানির ট্যাংকের কোন চিহ্ন চোখে পড়ল না।