খাদ ঘুরে ছুটল বব, তাড়া করে আসছে নিগ্রো, অনেক কাছে এসে পড়েছে। ছুটতে ছুটতে আবার বাধা পড়ল সামনে। জঙ্গলে ঢাকা একটা শুকনো খাড়িমত রয়েছে। ওটায় নেমে লুকিয়ে পড়া যায় না? এদিক ওদিক তাকাল সে। ছোট-বড় কয়েকটা গুহা চোখে পড়ল। সময় নেই। একটা গর্তে প্রায় লাফিয়ে নামল সে, ঢুকে বসে পড়ল। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল, যাতে হাঁপানোর শব্দ শোনা না যায়।
খাঁড়ির পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে ম্যাবরি, শব্দ শুনে বুঝতে পারল বব। এগিয়ে আসতে শুরু করল পাশের শব্দ, ববের গর্তটার দিকেই এগোচ্ছে। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মত আতঙ্কে থর থর করে কাঁপছে বব। আর রক্ষা নেই, ধরা বুঝি পড়তেই হবে। মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে পায়ের শব্দ, নিশ্চয়ই কোন গর্তের কিনারে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখে নিচ্ছে ম্যাবরি।
ববের গর্তটা বড় জোর পাঁচ কি ছয় ফুট গভীর, কিনারে এলে তাকে দেখতে পাবে ম্যাবরি। কিন্তু চুপ করে বসে থাকা ছাড়া এখন আর কিছু করারও নেই।
এগিয়ে আসছে পায়ের শব্দ, ম্যাবরির ভারি শ্বাস ফেলার শব্দও কানে আসছে এখন। আসছে…আসছে…তারপর থেমে গেল। ওপরে তাকাতে সাহস হচ্ছে না ববের, তবুও তাকাল। তার দিকেই চেয়ে রয়েছে নিগ্রোটা। দাঁত বের করে নীরবে হাসছে। ভয়ংকর ভঙ্গিতে হাতের তালুতে শান দিচ্ছে ক্ষুর।
গর্তের কিনারে লম্বা হয়ে শুয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল নিগ্রো। ববের চুল খামচে ধরে টান দিল। চিৎকার করে উঠল বব, ছটফট করছে, ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। চুল ছেড়ে তার ঘাড় চেপে ধরে টেনে তুলে আনছে ম্যাবরি, জবাই করার জন্যে ছাগলের বাচ্চাকে তুলছে যেন।
গর্তের বাইরে ববকে বের করে আনল ম্যাবরি। দাঁড় করিয়ে দিয়ে চুল খামচে ধরল আবার, টান দিয়ে মাথা পেছনে বাঁকা করতেই গলা ঠেলে এল সামনে। ক্ষুর চালানোর সুবিধে হবে। হাসিতে উজ্জ্বল ম্যাবরির মুখ চোখ জ্বলজ্বল করছে। ক্ষুর সোজা করল সে, এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। গলায় বসিয়ে হঠাৎ হ্যাঁচকা টান মারবে। আতঙ্কে হাত দিয়ে গলা রক্ষা করার কথাও ভুলে গেছে বব, সম্মোহিতের মত চেয়ে রয়েছে নিগ্রোর চোখের দিকে।
ঠা-শ্-শ্ করে একটা শব্দ হলো। বব মনে করল, চাপের চোটে তার ঘাড়ের হাড় ভেঙে গেছে। কিন্তু ব্যথা পাচ্ছে না কেন? ক্ষুরই বা চালাচ্ছে না কেন নিগ্রোটা? আরে, চেহারা দেখি বদলে গেছে ব্যাটার হঠাৎ করে! হাসি মুছে গেছে। কেঁপে উঠল। ম্যাবরির শরীর, হাত থেকে খসে পড়ে গেল ক্ষুর, পাথরে পড়ে শব্দ তুলল, ববের কানে মধুর বাজনার মত শোনাল সে শব্দ। তিন কি চার সেকেণ্ড ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল নিগ্রোটা, তারপর মুখ থুবড়ে পড়ল পাথরের ওপর।
চোখের সামনে থেকে বাধা সরে যেতেই লোকটাকে দেখতে পেল বর, ম্যাবরির ঠিক পেছনেই। ধরেই নিল বব, মরে গেছে সে, মৃতের রাজ্যে ঢুকে পড়েছে, তাই এমন সব আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা দেখতে পাচ্ছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই জলদস্যুর ভূত, বাঁ হাতে ভোজালি, ডান হাতে ধরা শত শত বছরের পুরানো পিস্তলের নল দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে।
বোবা হয়ে চেয়ে আছে বব। তার মগজ কাজ করতে চাইছে না যেন। কিন্তু একে একে দ্বিধার সমস্ত গিট ছাড়াল মগজ, খাপে খাপে বসিয়ে দিল সবকিছু।
চেঁচিয়ে উঠল বব, আপনি!
তিন
ডুবতে ডুবতেও ভেসে রইল বিমানটা। দূর থেকে দেখে মুসা কিংবা কিশোর যতখানি খারাপ ভেবেছে, ঠিক ততখানি খারাপ অবস্থায় নেই ওমর। কারণ সহজে ডুববে না বিমান, ভেতরে বাতাস ঢুকে আটকে গেছে, ভেসে রয়েছে ওই বাতাসের জন্যেই। ছোট একটা উপদ্বীপ বা পাথরের অনেক বড় স্তূপ, যা-ই বলা যাক, ওটার দিকে ভেসে চলেছে বিমান, মূল দ্বীপের এক মাথা থেকে বড়জোর শদুয়েক গজ দূরে, তার পরে খোলা সাগর।
উদ্বিগ্ন হয়ে উপদ্বীপটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ওমর। আশা, যদি কোনভাবে ওটাতে উঠে ঢেউ ছাড়িয়ে ওপরে উঠে যেতে পারে, তো বেঁচে যাবে এযাত্রা। তারপর ঝড় কমলে সাতরে চলে যেতে পারবে মূল দ্বীপে। কিন্তু কাছে যাবে কি বিমানটা?
যেতে পারে, না-ও পারে, ফিফটি ফিফটি চান্স। একবার তো উপদ্বীপের একেবারে কয়েক গজের মধ্যে চলে এল, কিন্তু ওমর ঝাঁপ দিয়ে পড়ার আগেই বিপরীতমুখী স্রোতের টানেই হোক, কিংবা বাতাসের ঝাঁপটায়ই হোক, দ্রুত সরে চলে এল আবার। খানিক পরে আবার এগোল বিমান, আবার পিছিয়ে এল। তারপর আবার এগোতে শুরু করল। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ওমর, ঝুঁকিটা নেবে, ঝাঁপ দিয়েই পড়বে পানিতে, তারপর সাঁতরে তীরে ওঠার চেষ্টা করবে, এছাড়া উপায় নেই। ও যা ভেবেছে-উপদ্বীপের একেবারে গায়ে বাড়ি খাবে বিমান, তা হবে না। বেশি সুবিধার জন্যে অপেক্ষা করলে শেষে আর কাছে না গিয়ে যদি স্রোতের টানে খোলা সাগরে ভেসে যায়, তাহলে সামান্য যে সুযোগ আছে, সেটাও মিলবে না।
তৃতীয়বার কাছাকাছি হতেই ঝাঁপ দিল ওমর। প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরাতে শুরু করল। কোনমতে এসে ধরে ফেলল বেরিয়ে থাকা একটা চোখা পাথর। ঢেউ আসছে, শব্দ শুনেই বুঝতে পারছে। লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে দম বন্ধ করে জোরে প্রায় জড়িয়ে ধরে রইল পাথরটা। এসে গেল ঢেউ, চলে গেল মাথার ওপর দিয়ে। কিন্তু সরার নাম নেই আর। দম ফুরিয়ে আসছে, বাতাসের জন্যে আকুলি-বিকুলি করছে ফুসফুস, আর পারছে না সে। সরল ঢেউ। এত জোরে টান দিল, ওমরের মনে হলো, গোড়া থেকে তার বাহু দুটো ছিঁড়ে শরীরটা নিয়ে চলে যাবে পানি। কিন্তু তার প্রচণ্ড মনোবলের কাছে হার মানল ঢেউ, নিতে পারল না।