গাছের গোড়ায় একটা নারকেল দেখে কাছে এসে উবু হতে যাবে, হঠাৎ চোখে পড়ল জিনিসটা, চাঁদের আলোয় চমকাচ্ছে ওটার শরীর। অবিশ্বাস্য। চোখ ডলে নিয়ে আবার তাকাল, না, আছে তো। ল্যাগুনের স্থির আলোয় ভাসছে একটা বিমান, চকচকে ডানায় জ্যোৎস্না প্রতিফলিত হয়ে এসে পড়েছে ববের চোখে। একবারও মনে এল না তার, ওটাতে চড়েই রওনা দিয়েছিল, ওটা তাদেরই সেই উভচর সিকরস্কি। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ভাবল, প্লেনের লোকগুলো গেল কোথায়? নিশ্চয়ই আশপাশেই কোথাও রয়েছে। সরে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজল, কিন্তু ল্যাগুনের ধারে খোলা ছোট্ট সৈকতে কাউকে চোখে পড়ল না। মনস্থির করে নিয়ে পা বাড়াতে যাবে, এই সময় একটা শব্দ শুনে চমকে উঠল সে, ধড়াস করে উঠল বুকের ভেতর। কাছেই আছে মানুষটা। নাক ডাকাচ্ছে।
জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিল বব। কী করবে? ডাকবে মানুষটাকে! প্লেনটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা ভাবনা ঝিলিক দিয়ে গেল তার মনে। নির্জন এই দ্বীপে এই সময়ে প্লেন আসে কি করে? সিকরস্কিটা না তো? ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো, চেনা চেনা মনে হচ্ছে এখন বিমানটাকে। আরও কয়েক মুহূর্ত পর আর সন্দেহ রইল না, ওটা সিকরস্কিই। আনন্দ চলে গেছে মন থেকে, তার জায়গায়। ঠাই নিয়েছে ভয়, সুযোগ দিলে ভয়টা আতঙ্কে রূপ নেবে। মন শক্ত করল সে। কি করবে? প্লেন চালাতে জানে না যে, ওটা নিয়ে পালাবে। তাহলে? হ্যাঁ, প্লেন চালাতে জানে না, কিন্তু নৌকা তো চালাতে পারে। রবারের ডিঙিটা নিয়ে চলে যেতে পারে। কাছের অন্য কোন দ্বীপে, এমন কোনটায়, যেটাতে মানুষের বাস আছে। কিন্তু তার আগে লুকিয়ে দেখে নেবে, হ্যামার আর সঙ্গীরা কি করছে। পুবের আকাশ ফ্যাকাসে হতে শুরু করেছে, মরে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার উজ্জ্বলতা, ভোরের দেরি নেই। যা কিছু করার করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি, আলো ফোঁটার আগেই।
নিঃশব্দে গাছপালার আড়ালে আড়ালে ঘুরে এসে দাঁড়াল পাথরের স্কুপের পিছনে। আস্তে করে মাথা উঁচিয়ে উঁকি দিল, যেদিক থেকে নাক ডাকার শব্দ আসছে। সেদিকে। ঢিবঢিব করছে বুকের ভেতর। সামনে একটুখানি খোলা জায়গা। পাশাপাশি শুয়ে আছে ছয়জন। কিন্তু চারজন তো থাকার কথা। একজন নড়েচড়ে উঠল। ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলল বব। কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করে সাবধানে আবার উঁকি দিল।
নড়ে উঠে এদিকে ফিরে শুয়েছে মূর্তিটা। খালি গা। চাঁদের আলো পড়েছে মুখে। দেখেই চিনতে পারল তাকে বব। কিশোর! গলার কাছে চিৎকারটা প্রায় এসে গিয়েছিল ববের, কোনমতে থামাল। বুকের ভেতরে ঢিবঢিব বেড়ে গেছে। কিশোর, তারমানে তার পাশে শোয়া মূর্তিটা মুসা। বোঝা যাচ্ছে, দুজনেরই হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে, তাদের পড়ে থাকার বেকায়দা ভঙ্গি দেখেই এটা স্পষ্ট।
সাহায্য করা দরকার ওদেরকে, কিন্তু কিভাবে? একটা ছুরির জন্যে এত আফসোস জীবনে আর কখনও করেনি বব। বাঁধনের গিট কি খুলতে পারবে? পারুক আর না পারুক, চেষ্টা করে দেখতেই হবে, সিদ্ধান্ত নিল সে। আকাশের দিকে তাকাল। ইস, এত তাড়াতাড়ি আলো ফুটছে কেন? মনেই পড়ল না, এই খানিক আগেও বার বার বলেছে, কেন আলো ফুটতে এত দেরি হচ্ছে। যা কিছু করার খুব দ্রুত করতে হবে, ডাকাতগুলো জেগে যাওয়ার আগেই।
পাথরের স্কুপের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে নেমে এল বব। কিশোরের চোখ মেলা, ববকে দেখছে চুপচাপ। জ্বলজ্বল করছে না? তাই তো মনে হয়, ভাবল বব। হাসল। তার হাসি কিশোরের চোখে পড়ল কিনা বোঝা গেল না।
কিশোরের পাশে এসে বসে পড়ল বব। পায়ের বাঁধনে হাত দিল। একবার চেষ্টা করেই দমে গেল। ভীষণ শক্ত করে বেধেছে। এই বাধন খুলতে অনেক সময় নেবে।
উঠে বসার চেষ্টা করছে কিশোর। বব ফিরে তাকাতেই ফিসফিস করে বলল, ক্ষুর! মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে দেখাল।
দেখতে পেল বব। খানিক দূরে চিত হয়ে শুয়ে আছে এক বিশালদেহী নিগ্রো, নীল জামা গায়ে, তার ছড়ানো হাতের কাছে পড়ে রয়েছে একটা ক্ষুর।
উঠে এগোল বব। ক্ষুরটা নেয়ার জন্যে হাত বাড়িয়েছে, এই সময় খুলে গেল নিগ্রোর চোখ।
জঘন্য একটা মুহূর্ত একে অন্যের দিকে চেয়ে রইল ওরা। গাল দিয়ে লাফিয়ে উঠে বসল ম্যাবরি।
পালাও, বব, দৌড় দাও! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
চমক ভাঙল যেন ববের, স্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠল। কিন্তু তার আগেই ক্ষুর হাতে উঠে পড়েছে নিগ্রো, সই করে হাত চালাল, অল্পের জন্য বাঁচল ববের গলাটা। লাগলে ধড় থেকে আলাদা হয়ে যেত মুণ্ড। আর কি দাঁড়ায় সে সেখানে! আতঙ্কে চেঁচিয়ে দৌড় দিল তাড়া খাওয়া পাহাড়ী ছাগলের মত। সৈকত ধরে ছুটছে, পেছনে তাকানোর সাহস নেই, কোথায় কোন্দিকে যাবে জানে না, শুধু বুঝতে পারছে, বাঁচতে চাইলে নিগ্রোর হাতে পড়া চলবে না। ধরে জবাই করে ফেলবে তাকে খুনেটা।
একটা পাহাড়ে উঠে পড়ল বব, উঠে চলল দ্রুত। পেছনে গুলির শব্দ হলো, ববের পায়ের কাছ থেকে উঠে গেল এক খাবলা মাটি। আরেকটা গুলি লাগল প্রথমটার কাছেই, আরেক খাবলা মাটি উড়ল। থামল না বব। বড় একটা খাদের কাছে এসে থমকে দাঁড়াতেই হলো অবশেষে। সামনে যাওয়ার পথ নেই। ফিরে তাকিয়ে দেখল, উঠে আসছে নিগ্রো।
ঘুরে এক পাশে ছুটল আবার বব। ঢুকে পড়ল ঘন জঙ্গলে। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই বুঝল, ভুল জায়গায় ঢুকেছে। ঘন হয়ে জন্মানো লিয়ানা লতা আর কাটাঝোঁপের ভেতরে ছুটে চলা মানুষের সাধ্যের বাইরে। আবার বেরিয়ে এসে বা দিক দিয়ে খাদটা ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করল। জানে না, এটা সেই জায়গা, হ্যামারের তাড়া খেয়ে তার বাবাও একদিন যেদিক দিয়ে ছুটেছিল।