আরেকবার বমি করল সে, পেট থেকে নোনা পানি সব বেরিয়ে যাওয়ার পর সুস্থির হলো। তাকাল চারপাশে। সঙ্গীদেরকে দেখার আশা করছে না, দেখা গেলও না কাউকে। বিমানটাও নেই। একা সে, ভয়ংকর একাকীত্ববোধ প্রচণ্ড পীড়া দিতে শুরু করল তাকে। অন্য তিনজন পানিতে ডুবে মরেছে, এটা বিশ্বাস করতে পারছে।, বেঁচে আছে ওরা, নিরাপদে আছে, তা-ও বিশ্বাস হচ্ছে না। পানির ধার ঘেঁষে পড়ে থাকা সাদাটে একটা জিনিস চোখে পড়ল তার, কম্পিত পায়ে এগোল সেদিকে। খানিক এগিয়েই বুঝতে পারল কি ওটা, কাছে যাওয়ার দরকার হলো না–বিমানের সিঁড়ি, ওরা যেটাতে করে এসেছিল, সেটার। জোর করে চেপে রাখা পানি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারল না, দরদর করে বেরিয়ে এল চোখ থেকে। আর অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। ধপ করে বালিতে বসে দুহাতে মুখ ঢাকল বব।
কতক্ষণ একই ভাবে বসে থাকল বলতে পারবে না, অবশেষে উঠে দাঁড়াল। আবার, এভাবে ভেঙে পড়ার কোন মানে নেই। পেছনের ঘন জঙ্গলের দিকে চেয়ে। আত্ম কেঁপে গেল, কি ধরনের জানোয়ারের বাসা ওই জঙ্গলে? কি আতঙ্ক আর বিপদ ওঁৎ পেতে আছে কালো গাছগুলোর আড়ালে? জানে না সে, এখান থেকে দেখে কিছু বোঝারও উপায় নেই।
দূর, যত্তোসব আজেবাজে ভাবনা!-ধমক দিয়ে মন থেকে ভয় তাড়ানোর চেষ্টা করল সে। আবার ফিরল সাগরের দিকে। আরে, ওই তো, ওই সেই পাথরটা। যেটাতে নামার চেষ্টা করেছিল সে। বানের পানি চলে যাওয়ায় অনেক উঁচু হয়ে আছে, নিশ্চয়ই শুকনো। ঢেউয়ের দাপাদাপি আর নেই এখন ওটাকে ঘিরে। তার বন্ধুরা কি ওখানেই আছে, টিলার ওপরে বা নিচে কোথাও পড়ে আছে তাদের লাশ? ববের বাবা বলত, খুন করে লাশ গুম করে না সাগর, ফিরিয়ে দিয়ে যায়।
যাবে নাকি? গিয়ে দেখবে? ডানে-বাঁয়ে ভালমত তাকাল আবার, কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না। খাড়া পাহাড়ের ধার ঘেঁষে এগোল, এখান দিয়েই যাওয়ার চেষ্টা করেছিল তখন কিশোর আর মুসা, পানি থাকায় পারেনি, কিন্তু এখন শুকনো, ববের যেতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। পাথরের টিলার কাছে চলে এল, গোড়ায় নেই কেউ, ওপরে চড়ল, না, এখানেও নেই। ফিরে এল আবার সৈকতে, পানি থেকে দূরে একেবারে জঙ্গলের ধারে উঠে এল। ভয়ে ভয়ে তাকাঁচ্ছে কালো বনের দিকে। বসল। এরপর কি করবে, ভাবছে। পানি দরকার আগে, গলা শুকিয়ে কাঠ। কিন্তু পানি খুঁজতে যাওয়ার সাহস নেই, চাঁদের আলোয় অদ্ভুত আলো-আঁধারির খেলা জায়গায় জায়গায়, নির্জন নীরব এই পরিবেশে সেদিকে তাকাতেই গা ছমছম করছে ববের। ভোরের জন্যে অপেক্ষা করবে ঠিক করল সে। ডান হাতের তালুতে চিবুক রেখে ভাবতে লাগল নানা কথা, শূন্য দৃষ্টি স্থির একটা পাথরের স্তূপের দিকে।
বসে আছে তো আছেই। এত দীর্ঘ রাত আর আসেনি তার জীবনে। ভাগ্য ভাল, বাতাস উষ্ণ, নইলে খালি গায়ে যেভাবে বসে আছে খোলা বাতাসে, এভাবে থাকতে পারত না কিছুতেই, খুব অসুবিধেয় পড়ে যেত। নিজের কক্ষপথে নীরবে, এগিয়ে চলেছে চাঁদ, ববের ডানে সৈকত ঘুরে চলেছে যেন, অবশেষে তার বায়ের পাথরগুলোর ছায়া দূর হলো চাঁদের আলো পড়ে, নীলচে উজ্জ্বল একটা আভা ছড়াচ্ছে এখন।
এই দুরবস্থায় থেকেও ঢুলুঢুলু হয়ে এল তার চোখ এক সময়, ঠিক তখনই একটা পাথরকে নড়তে দেখল সে, নাকি কল্পনা? নাহ্, কল্পনাই। যে অবস্থায় রয়েছে সে, তাতে চোখ উল্টোপাল্টা অনেক কিছুই দেখতে পারে, মানে, দেখেছে মনে হতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই পুরো সজাগ হয়ে গেল সে, প্রতিটি স্নায়ু টানটান। পাথরটা সত্যিই নড়ছে, ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে একটা মানুষে, চোখ বড় বড় করে ওটার দিকে চেয়ে থেকে ভাবছে বব, সে স্বপ্ন দেখছে। হয় স্বপ্ন দেখছে, না হয় ওই জিনিস, যাকে সবচেয়ে বেশি ভয় তার। ভূত! ভূত মনে করার কারণও আছে। যে মানুষটাকে দেখছে সে, সে আধুনিক মানুষের পোশাক পরা নয়। মাথায় ছিটকাপড়ের রুমাল জড়ানো, একটা কোনা ঝুলছে ঘাড়ের ওপরে। ফতুয়ার মত একটা জামা পরনে, বুকের কাছটায় সুতার পাকানো সরু দড়ির আড়াআড়ি বুনট, ঢোলা রঙিন পাজামার নিচের দিক ঢোকানো বুটের ভেতরে-রূপার বাকলস লাগানো। রয়েছে জুতোতে, চাঁদের আলোয় চকচক করছে। আরও একটা জিনিস চকচক করছে, সেটা তার হাতের মস্ত ভোজালি, চোখা মাথাটা ঠেকিয়ে রেখেছে। কটা পাথরে।
হাঁ হয়ে গেছে বব, নিঃশ্বাস ফেলতে ভয় পাচ্ছে। আস্তে ঘুরল মূর্তিটা, তাকিয়ে রইল প্রবালপ্রাচীরের গায়ে যেখানে ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে, সেদিকে। তারপর যেমন, নীরবে এসেছিল, তেমনিভাবেই গায়েব হয়ে গেল আবার।
আর কোন সন্দেহ নেই ববের, ভূতই দেখেছে, শত শত বছর আগে অপঘাতে মরা কোন জলদস্যুর ভূত! সারাজীবন যা করেছে, মৃত্যুর পরেও সেই পেশাই বোধহয় বেছে নিয়েছে ভয়ঙ্কর ওই জলদস্যু! কিন্তু আরেকবার ওটাকে দেখার অপেক্ষা করল না বব, লাফিয়ে উঠে ছুটল বালিয়াড়ি ধরে। আরেকটা বড় পাথরের স্তূপ চোখে পড়ার আগে গতি কমাল না। কাঁধের ওপর দিকে ফিরে তাকাল। ভূতটা তাড়া করে আসছে না দেখে থামল, হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে। বসে পড়ে জিরিয়ে নিল খানিকক্ষণ, চোখ সারাক্ষণ রয়েছে যেদিক দিয়ে সে এসেছে সেদিকে। ভূতটার ছায়া দেখলেই উঠে দৌড় দেবে আবার।
আর দেখা দিল না ভূত। জিরিয়ে নিয়ে উঠল বব। সামনের পাথরের ফাঁকফোকর দিয়ে গজিয়ে উঠেছে কয়েকটা নারকেল গাছ। যাক, পানি পাওয়া যাবে। একটা নারকেল জোগাড়ের আশায় পা বাড়াল সে নারকেল-কুঞ্জের দিকে।