স্থির দৃষ্টিতে ওমরের মুখের দিকে চেয়ে আছেন ক্যাপ্টেন। তার মানে, বলতে চাইছেন সত্যিই গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছেন আপনারা?
একটা দুটো নয়, হাজার হাজার।
তাই?
বলেছিলাম না, স্যার, মোহর আছে, অনেক মোহর, বলে উঠল ববের বাবা।
শুধু মোহর না, ওমর বলল, আরও অনেক মূল্যবান জিনিস আছে দ্বীপে।
নিশ্চয়ই গ্যালিয়নটা খুঁজে পেয়েছেন আপনারা? কলিনস যেটার কথা বলছিল?
হ্যাঁ। আমার সঙ্গে গেলে দেখাতেও পারি। কিন্তু আগে আমাদের পানি আর খাওয়া…
উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আগে ঠাণ্ডা হয়ে নিন, তারপর বলবেন সব কিছু। আমি তোক পাঠিয়ে দিচ্ছি দ্বীপে।
গায়ে সাবান মাখতে মাখতে বাবার সঙ্গে কথা বলছে বব। জানা গেল, হ্যামারের ছুরি খেয়ে সেদিন মরেনি কলিনস, দমটা ছিল কোনমতে। যমে-মানুষে টানাহেঁচড়া করে শেষে ডাক্তাররা বাঁচিয়েছে তাকে। অনেক সময় লেগেছে সুস্থ হতে। ভাল হয়েই আরেকটা চিঠি লিখেছে ববের কাছে, কিন্তু পায়নি বব, সে তখন বেরিয়ে পড়েছে গুপ্তধনের সন্ধানে। জ্যামাইকার কিংসটন বন্দরে চলে গেছে এরপর কলিনস, ওখানেই দেখা ডেস্ট্রয়ারের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে। প্রাচীন গ্যালিয়ন আর মোহরের কথা কৌতূহলী করে তুলেছে তরুণ ক্যাপ্টেনকে। বিশ্বাস করার আরও কারণ ছিল, কলিনস যে এলাকার কথা বলেছে, ওখানে আগেও কয়েকটা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, তাছাড়া ওই এলাকাটা, এককালে ছিল জলদস্যুদের স্বর্গরাজ্য। ভেবেচিন্তে শেষে কলিনসকে জাহাজে তুলে নিলেন ক্যাপ্টেন।
জানা গেল, মাত্র আগের দিন বিকেলে বেতারে একটা মেসেজ পেয়েছেন। ক্যাপ্টেন, ম্যারাবিনার প্যান-আমেরিকান রেডিও স্টেশন মেসেজটা পাঠিয়েছে, চারজন আমেরিকানকে নিয়ে একটা বিমান নিখোঁজ হয়েছে দক্ষিণ সাগরের কোথাও। গুপ্তধন নয়, বিমানটাকেই খুঁজছিল ডেস্ট্রয়ার। কামানের গোলার শব্দ কানে আসতেই দ্রুত গতিতে ছুটে এসেছে খোঁজ নিতে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে বব আর ববের বাবা, দুজনের কেউ কাউকে আশা করেনি এখানে।
এক ঘণ্টা পর। বেশ ভাল একটা ভূরিভোজন শেষে চার অভিযাত্রীকে আবার নিয়ে আসা হলো সামিয়ানার নিচে। সিকরস্কিটাকে উদ্ধার করে এনে ডেস্ট্রয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। মৃদু ঢেউয়ে দুলছে ওটা স্বচ্ছ নীল পানিতে। ক্যাপ্টেনের চেয়ারের পাশে তূপ করে রাখা হয়েছে মোহর।
চেয়ারে বসল অভিযাত্রীরা।
ওমরকে বললেন ক্যাপ্টেন, এবার শুরু করুন আপনার কাহিনী। তাড়াহুড়োর দরকার নেই, খুলেই বলুন সব।
কফির কাপ টেনে নিল ওমর। তারপর শুরু করল গল্প। একেবারে গোড়া থেকে, কিছুই গোপন করল না, মাঝে মাঝে কথা যোগ করল তিন কিশোর। রুদ্ধশ্বাসে শুনলেন ক্যাপ্টেন আর তার অফিসারেরা।
অবিশ্বাস্য, ওমরের কথা শেষ হলে বললেন ক্যাপ্টেন। চোখের সামনে প্রমাণ রয়েছে, তা-ও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। …তো, আপনাদের এখন কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে?
দেশে।
হ্যাঁ, তাই যেতে হবে। আপনাদেরকে ছাড়তে পারছি না এখন, সরি, যেতে হবে আমাদের সঙ্গেই। একটা কোর্ট অভ ইনকয়্যারী হবে, তারপর আদালত থেকে। যা রায় হয়, হবে। হাজার হোক, মানুষ খুন করেছেন আপনারা।
কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে করেছি। আর কোন উপায় ছিল না।
বুঝতে পারছি। মাননীয় আদালতও নিশ্চয়ই বুঝবেন। কিছু হবে না আপনাদের। এই একটা রুটিন শুনানী, তারপর খালাস দিয়ে দেয়া হবে। তবে মোহর সব পাবেন না আপনারা, আইন অনুযায়ী অর্ধেক নিয়ে নেবে স্টেট।
নিক। তার পরেও যা থাকবে, অনেক টাকার জিনিস, হাসল ওমর। আর মোহর! প্রাণে যে বেঁচেছি এই-ই যথেষ্ট। আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ।
ও হ্যাঁ, বললেন ক্যাপ্টেন, ট্রলারে একজন সিভিলিয়ান ছিল। লাশের পকেটের কাগজপত্র ঘেঁটে তার নাম জানা গেছে, সিডনি…
…বারডু, বলে উঠল ওমর। ও-ই পাইলট, আমাদের বিমান চোরদের একজন। ম্যারাবিনা থেকে চুরি করেছিল। হ্যামারের সঙ্গে ওর থাকার কথা, তাই ভাবছিলাম, বারডু গেল কোথায়? বোধহয় ডেকের নিচে থাকতেই আমাদের গুলি লেগে মরেছে।
গোলা লেগে, শুধরে দিলেন ক্যাপ্টেন। শরীরের অর্ধেকটা উড়ে গেছে, যেন। শেলের আঘাতে…।
গোলাও নয়, হাসল ওমর। আদিম সুইভেল-গানের কাণ্ড।
হু। আচ্ছা, চলুন এখন দ্বীপে যাই। গ্যালিয়নটা দেখান আমাদের। দুর্গও। এসব প্রাচীন জিনিসের প্রতি আমার ভারি কৌতূহল। যাবেন?
সানন্দে। আসলে, আমরাও ভালমত দেখতে চাই জাহাজটা। সেদিন তাড়াহুড়ো ছিল, তাছাড়া অন্ধকার, দেখতে পারিনি সব।
বাকি দিনটা দ্বীপে কাটাল অভিযাত্রীরা, কখনও একা, কখনও দলবল নিয়ে। রাজকীয়-গ্যালিয়নের ভেতরে বাইরে যতখানি দেখা সম্ভব, দেখল। দ্বীপটা ঘুরে দেখল। সারাক্ষণ তাদের সঙ্গে সঙ্গে রইল নৌ-বাহিনীর একজন গার্ড। যখন অন্ধকার হলো, আর কিছু দেখা গেল না, তখন ফিরে এল ওরা জাহাজে। দুর্গ থেকে লুই ডেকেইনির কালো পতাকাটা খুলে নিয়ে এসেছে বব, বন্ধুদের অনুমতি নিয়ে রেখে দিয়েছে ওটা তার কাছে, ট্রফি।
পরদিন সকালে সূর্য ওঠার পর ছাড়ল ডেস্ট্রয়ার। রাতের বেলায়ই বেতারে কিংস্টনে আমেরিকান নৌ-ঘাঁটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন ক্যাপ্টেন, তার ওপরওয়ালার সঙ্গে কথা বলেছেন। সোজা ওখানে গিয়ে রিপোর্ট করার আদেশ পেয়েছেন ক্যাপ্টেন।
ক্রেন দিয়ে টেনে তুলে ডেকে বহাল তবিয়তে ক্যানভাসের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সিকরস্কিটাকে। ডেক চেয়ারে বসে কফি খেতে খেতে কথা বলছে ওমর আর ববের বাবা।