অফিসার। অভিযাত্রীদের দিকে চেয়ে হাসল কয়েকজন নাবিক।
হালকা পায়ে সিঁড়ি বেয়ে চত্বরে উঠে এল অফিসার। আদিম কামান বন্দুকগুলোর দিকে চেয়ে থমকে গেল। একে একে তাকাল চারটে বারুদে-মাখামাখি
শরীরের দিকে। কি ব্যাপার? ডাকাত পড়েছিল নাকি?
হ্যাঁ, জবাব দিল ওমর। আরেকটু হলেই দিয়েছিল শেষ করে। অনেক কষ্টে বেঁচেছি। লড়াই করে।
এগুলো দিয়ে?
খেলনা ভাবছেন নাকি? একেকটা গোলা যে কাণ্ড করেছে, যদি দেখতেন…সুইভেল-গানটার কথা বাদই দিলাম।
কালো পতাকাটার দিকে চোখ পড়তে ভুরু কোঁচকালো লেফটেন্যান্ট। জলদস্যু?
আধুনিক জলদস্যু।
আপনারা?
আমরা ট্রেজার আইল্যাণ্ডের গুপ্তধন-সন্ধানী, পরিবেশ হালকা করার জন্যে নাটকীয় ভঙ্গিতে বাউ করল ওমর। ধরে নিন, আমি ক্যাপ্টেন স্মলেট। আর এই যে ইনি স্কয়ার ট্রেলনী, ইনি ডক্টর লিভসী, আর ও জিম হকিনস। আর এই যে, বাঁকা হয়ে পড়ে থাকা হ্যামারের লাশটা দেখাল, এ হলো লঙ জন সিলভার।
মারা গেছে?
উপায় ছিল না। না মারলে আমরা মরতাম।
আদিম কামান-বন্দুক, জলদস্যুর কালো পতাকা, অভিযাত্রীদের পোশাক আশাক আর অবস্থা দেখে বোকা হয়ে গেছে যেন অফিসার, ব্যাপারটাকে কি ভাবে নেবে বুঝতে পারছে না। তবে তার হাবভাবে মনে হলো, অভিযাত্রীদের পাগল ভাবছে সে। তা গুপ্তধন মিলল?
নিশ্চয়ই। নইলে এত খুনখারাপী কেন? মোহরের স্তূপ দেখাল ওমর। ওই যে। চাইলে দুএকটা নিতেও পারেন, স্যুভনির রাখবেন।
হাঁ হয়ে গেল অফিসার। এগোবে কিনা ভাবতে ভাবতেই চোখ পড়ল হ্যামারের পাশে পড়ে থাকা একটা মোহরের দিকে। নিচু হয়ে সেটা তুলতে গেল।
হাঁ-হাঁ করে উঠল ওমর। ওটা না, ওটা না। নিলে মরবেন। লাফিয়ে এসে ছো মেরে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। চকিতের জন্যে সোনালি একটা ধনুক সৃষ্টি করে উড়ে গেল ডাবলুনটা, পড়ল পানিতে। হারিয়ে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
অভিশপ্ত। অনেক মানুষের প্রাণ নিয়েছে।
কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ল লেফটেন্যান্ট। চলুন, জাহাজে চলুন। ক্যাপ্টেনকে সব খুলে বলবেন।
খুব ভাল কথা, চলুন, খুশি হলো ওমর।
অফিসারের পিছু পিছু নেমে এল ওরা বোটে।
দশ
ভাগ্য ভাল আমাদের, আপনারা এসেছেন, লেফটেন্যান্টের সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করল ওমর। কেন এসেছিলেন?
হাসল অফিসার। কেন? যে কাণ্ড করেছেন আপনারা, ওয়েস্ট ইণ্ডিজের অর্ধেকটা কাঁপিয়ে দিয়েছেন। বিশ মাইল দূর থেকে গোলার আওয়াজ শুনেছি, কালো ধোয়া দেখেছি। আমরা তো ভাবছিলাম, দ্বীপপুঞ্জগুলো যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছে। এরপরেও দেখতে আসব না?
অ। হাসল ওমর। জাহাজের কাছে চলে এসেছে বোট। রেলিঙে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৌতূহলী দর্শক, তাদের দিকে তাকাল সে।
অস্ফুট শব্দ করে উঠল বব। ফিরে চেয়ে দেখল ওমর, চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। ববের। ফ্যাকাসে চেহারা।
কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল ওমর। ব্যথা লেগেছে কোথাও?
না, কিছু না, মাথা নাড়ল বব।
কিছু তো বটেই। কি?
মনে হলো…মনে হলো, বাবাকে দেখলাম! ডেকে, নিচু গলায় বলল সে।
ঝট করে মুখ ফিরিয়ে রেলিঙের কাছে দর্শকদের দেখল আরেকবার ওমর। কই, কোথায়?
ববের কথা অফিসারের কানেও গেছে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ববের দিকে। তুমি কলিনস না তো?
হ্যাঁ, কলিনস, বব কলিনস, অবাক হলো বব, তার নাম জানল কি করে। লোকটা?
তাহলে ঠিকই দেখেছ, মাথা কাত করল লেফটেন্যান্ট। তোমার বাবাই। এক বন্দরে আমাদের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন তাকে আগে থেকেই চিনতেন। অদ্ভুত এক গল্প শোনাল কলিনস, গুপ্তধনের গল্প। সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করল ক্যাপ্টেনকে। এমনভাবে বলল, যাচাই করে দেখতে রাজি হয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন, তাছাড়া এদিক দিয়েই যাওয়ার কথা আমাদের। কলিনসকে জাহাজে তুলে নিলেন তিনি।
কিন্তু ববের কানে অফিসারের কথা ঢুকল কিনা বোঝা গেল না। রেলিঙের দিকে চেয়ে রয়েছে সে। আরেকজন মধ্যবয়েসী দর্শক এসে দাঁড়িয়েছে, ববের মতই চুলের রঙ, একজন সিভিলিয়ান।
জাহাজের গা ছুঁল বোট। সিঁড়ি নামানো হলো। কারও অনুমতির অপেক্ষা না করে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে গেল বব। সোজা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সিভিলিয়ান লোকটার বাড়ানো দুই হাতের মাঝে।
উঠে গেল ওমর, কিশোর আর মুসা। বব আর তার বাবার তখন মুখে হাসি, চোখে পানি। দর্শকরা ঘিরে ধরল অভিযাত্রীদেরকে।
সাড়া ফেলে দিয়েছি মনে হচ্ছে, কিশোরের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল ওমর।
মাথা ঝোঁকাল শুধু কিশোর।
জাহাজের পেছন দিকে ডেকে একটা কাঠের সামিয়ানার তলায় অপেক্ষা করছেন ক্যাপ্টেন। অভিযাত্রীদের তাঁর কাছে নিয়ে এল লেফটেন্যান্ট, পেছন পেছন এল কৌতূহলী দর্শকের দল।
ক্যাপ্টেনের বয়েস অল্প, তরুণ। বিচিত্র পোশাক পরা অভিযাত্রীদের দেখে একই সঙ্গে কৌতূহল, সন্দেহ আর বিস্ময় ফুটল তার চোখে। ইঙ্গিতে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন তাদেরকে। জিজ্ঞেস করলেন, দলপতি কে?
ইনি, ওমরকে দেখিয়ে দিল কিশোর।
কি হয়েছিল? আবার প্রশ্ন করলেন ক্যাপ্টেন।
সবই বলব, ওমর বলল, কিন্তু তার আগে পানি খাওয়ান আমাদের। গোসলও করতে হবে। হাতমুখের যা অবস্থা। হাসল সে।
পানি আনতে বললেন ক্যাপ্টেন। আর?
দ্বীপের ধারে একটা ল্যাগুনে আমাদের প্লেন আছে, শত্রুরা দখল করে নিয়েছে, ওটা ফিরিয়ে আনতে লোক পাঠান, প্লীজ। আর আপনার লেফটেন্যান্ট সাহেব আমাদেরকে যেখান থেকে নিয়ে এসেছেন, অনেক মোহর আছে ওখানে, ওগুলোও আনা দরকার। তাড়াতাড়ি না করলে লুট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিছু ডাকাত দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছে। মোহর নিয়ে প্লেনে করে পালাতে পারে।