ওমরের কানের কাছে গর্জে উঠল পিস্তল, পলকের জন্যে বধির হয়ে গেল সে। এবারও হ্যামারের গায়ে লাগল না, তার পেছনের আরেকটা লোক উল্টে পড়ল, তার ধাক্কায় গড়িয়ে পড়ল আরেকজন।
ফিরেও তাকাল না হ্যামার, উঠে এল ওপরে, তার প্রায় গায়ে গা ঘেঁষেই এল। আর দুজন।।
যে-কোন একটা অস্ত্রের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে ওমর। কামানে আগুন দিয়েছিল যে ভোজালিটা দিয়ে কিশোর, সেটা চোখে পড়তেই তুলে নিতে ছুটল, কিন্তু ধাড়ম করে উপুড় হয়ে পড়ল একটা পাথরে পা বেধে। বনবেড়ালের মত তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল হ্যামার।
একেবেঁকে পিছলে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল ওমর, পারল না, তার বুকের ওপর চেপে বসল হ্যামার। রোদে ঝিক করে উঠল তার হাতের ছুরির তীক্ষ্ণধার ফলা। দাঁত বের করে কুৎসিত হাসি হাসল ডাকাতটা, ওমরের গলার ওপর ধীরে ধীরে নামিয়ে আনছে ছুরি, জবাই করবে।
গর্জে উঠল পিস্তল। স্থির হয়ে গেল হ্যামারের হাত, খসে পড়ল ছুরি, ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে এক পাশে টলে পড়তে শুরু করল সে নিজেও। স্লো মোশন ছায়াছবির মত ঘটছে ঘটনা।
ধাক্কা দিয়ে হ্যামারকে গায়ের ওপর থেকে ফেলে উঠে বসল ওমর। ফিরে চেয়ে দেখল, দুহাতে পিস্তল উঁচিয়ে ধরে কাঁপছে কিশোর, নল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ছাই হয়ে গেছে মুখ।
থ্যাঙ্কিউ, কিশোর, ফাসফেঁসে কণ্ঠে বলল ওমর। পরক্ষণেই ভোজালিটা তুলে নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে গেছে হ্যামারের সঙ্গীসাথীরা। ওমরকে ভোজালি হাতে উঠে দাঁড়াতে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেল। আক্রমণ আর করল না, নেতার পতন ঘটার পর সাহস আর মনের জোর দুই-ই হারিয়েছে ওরা। অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওপর থেকেই ঝপাঝপ লাফিয়ে পড়ল সাগরে। ব্যাপার দেখে ঘাবড়ে গেল জাহাজীরাও, বিধ্বস্ত জাহাজটাকে সরিয়ে নিতে শুরু করল। ধুম ধুম করে গুলি চালাল মুসা আর বব।
ব্যস, হয়েছে, হাত তুলল ওমর। গুলি থামাও।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে কিশোর। চুল উস্কোখুস্কো। হাঁপাচ্ছে আর, ঘামছে। পিস্তলটা পড়ে আছে এক পাশে।
মুসার চোখ লাল, ধপ করে বসে পড়ল। আস্তিন দিয়ে রক্ত মুছল গালের একটা কাটা থেকে।
বব যেন নিষ্প্রাণ একটা পুতুল, শূন্য চোখে চেয়ে আছে ট্রলারটার দিকে।
বেশি কেটেছে? মুসাকে জিজ্ঞেস করল ওমর।
নাহ্, দুর্বল কণ্ঠে বলল মুসা। একটা গুলি পাথরে বাড়ি খেয়ে এসে লেগেছিল।
জাহাজটার দিকে ফিরে চাইল ওমর, পঞ্চাশ গজ দূরে গিয়ে নাক ঘোরাচ্ছে। তীরের দিকে। শিক্ষা হয়েছে ব্যাটাদের। একটা ডাব এনে ভোজালি দিয়ে কেটে, মুসার দিকে বাড়িয়ে ধরল। নাও, খেয়ে নাও, ভাল লাগবে।
এক ডাবে কি হবে, এক বালতি পানি দরকার, ডাবটা হাতে নিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল মুসা। এত পিপাসা জীবনে লাগেনি। নৌকাটা কোথায়?
আমাদেরটা? ডুবে গেছে। ধাক্কা দিয়ে চ্যাপ্টা করে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। জাহাজটা তীরের দিকে যাচ্ছে, পানি উঠছে হয়তো। উঠুক আর না উঠুক, আজ আর আসছে না। …মাথা অত উঁচিও না, নোয়াও, গুলি করে বসতে পারে। …আচ্ছা, সিডনি বারভুকে দেখলাম না তো। তোমরা দেখেছ?
না, মাথা নাড়ল কিশোর।
বব আর মুসা জানাল, ওরাও দেখেনি।
প্লেনটা দখল করতে না পারলে লাভ হবে না কিছু, চিন্তিত হয়ে পড়ল ওমর। ছাতে উঠল গিয়ে। ল্যাগুনে বিমানটা আছে কিনা দেখবে। সাগরের দিকে একটা নড়াচড়া দৃষ্টিগোচর হতেই ঝট করে ঘুরল ভালমত দেখার জন্যে। হায়, আল্লাহ! চেঁচিয়ে উঠল সে।
আরও বিপদ আসছে মনে করে ছাতে উঠে এল অন্যেরা। বড় জোর মাইল খানেক দূরে, দ্বীপের দিকে মুখ করে ছুটে আসছে লম্বা একটা বড় জাহাজ।
সর্বনাশ! বিড়বিড় করল বব। ডেস্ট্রয়ার। ওটা হামলা চালালে আর ঠেকাতে পারব না।
তীক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে হঠাৎ হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। না, না, আক্রমণ করবে না। আমেরিকান। নেভির শিপ, বুঝতে পারছ না? …কিন্তু এখানে এল কেন? জলদস্যুতা শেষ হয়ে গেছে অনেক বছর আগে, টহল দিচ্ছে না জাহাজটা। দেখি, কি করে।
ইস্ যদি আমাদের তুলে নিত, বলল মুসা। এক প্লেট ডিম ভাজা আর রুটি যদি খেতে দিত, আর কিছু পনির, একটা মুরগী, কলা…
বোলো না আর, দুহাত নাড়ল বব, বোলো না।
ববের কথার ধরনে হেসে ফেলল সবাই। জানে, বিপদ পুরোপুরি কাটেনি এখনও, দোদুল্যমান অবস্থা, কিন্তু জাহাজটা দেখে হালকা হয়ে গেছে সবার মন। কেন যেন মনে হচ্ছে, ওটা শত্রুপক্ষের নয়।
কোনভাবে জানাতে পারি না, আমরা এখানে আছি? প্রস্তাব দিল মুসা।
হ্যাঁ, ঠিক, সায় দিল ওমর। এসো, চেঁচাই সবাই মিলে…
একসঙ্গে জোরে চিৎকার করে ডাকল ওরা, কিন্তু কোন সাড়া এল না।
কালা নাকি সব? গোঁ গোঁ করল মুসা। ডিম ভাজার চিন্তায় বিমর্ষ। আবার ডাকি?
চিৎকার করে আবার ডাকল ওরা। সাড়া মিলল না এবারেও। তবে থামতে শুরু করল ডেস্ট্রয়ার। বোট নামল। ঝিলিক দিয়ে উঠল ছয় জোড়া ভেজা দাঁড়, দ্রুত গতিতে ছুটে এল নৌকাটা উপদ্বীপের দিকে। গলুইয়ের কাছে বসে আছে সাদা পোশাক পরা একজন অফিসার।
ছাদ থেকে চত্বরে নেমে এল অভিযাত্রীরা। ছুটে এসে দাঁড়াল ভাঙা নিচু দেয়ালের ধারে। নৌকা কাছে আসতেই ডেকে বলল ওমর, ওদিক দিয়ে ঘুরে আসুন। সিঁড়ি আছে।
স্পষ্ট আদেশ শোনা গেল। উপদ্বীপের এক পাশ ঘুরে সিঁড়ির কাছে এসে থামল নৌকা। পানিতে ভাসছে খানিক আগের খণ্ডযুদ্ধের আলামত। অবাক হয়ে দেখছে।