উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ওমর। আরেকটু এগোলেই কামানের রেঞ্জের এপাশে চলে আসবে জাহাজ। নোয়াতে নোয়াতে একেবারে চত্বরের সঙ্গে লেগে গেছে নলের মুখ, আর নামানো যাবে না। কোনমতে সিঁড়ির কাছাকাছি জাহাজ আনতে পারলে আর ঠেকানো যাবে না সৈন্যদেরকে, দরকার হলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাতরে চলে আসবে, তারপর উঠে আসবে সিঁড়ি বেয়ে।
তবে, এখনই সবচেয়ে বড় সুযোগ। কামানের আওতায় রয়েছে জাহাজ, খুবই কাছে। কোনমতে একটা গোলা ডেক পার করে যদি ইঞ্জিন রুমে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, ব্যস, হয়ে গেল কাজ। ইঞ্জিন তো যাবেই, ডেকে লুকিয়ে থাকা সৈন্যও মরবে বেশ কিছু।
হঠাৎ ডেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল সৈন্যরা। তাদের মাঝে রয়েছে হ্যামার, চেঁচিয়ে সাহস দিচ্ছে সবাইকে, গুলি করতে বলছে।
গুলি শুরু করল সৈন্যরা।
ঘামে ভিজে সপসপ করছে ওমরের গা। টেনে ছিঁড়ে গা থেকে শার্টটা খুলে ফেলে দিল। মরিয়া হয়ে উঠেছে বেদুইন। কিছুতেই পরাজয় বরণ করবে না, যে। করে হোক ঠেকাবেই দুশমনকে। মাথা নোয়াও, নুইয়ে রাখো! চেঁচিয়ে বলল সে।
ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে লাগছে পেছনের দেয়ালে, কোনটা খসে পড়ছে চত্বরে, কোনটা পিছলে যাচ্ছে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে। মারাত্মক।
সুইভেল-গানটা সরিয়ে আরেকটু সামনে নিয়ে এল ওমর। ডেক সই করে ছাড়ল আরেক ঝক গুলি। সুইভেল-গান ব্যবহার শেষ, আর নাগাল পাবে না জাহাজের। ছিঁড়েখুঁড়ে গেল ডেক, দুজন সৈন্য পড়ে গেল, কিন্তু ইঞ্জিন আগের মতই সচল।
মরিয়া হয়ে উঠেছে তিন কিশোরও। মাসকেট তুলে সারেঙকে লক্ষ্য করে গুলি করল কিশোর। নিশানা ভাল না, সারেঙের মাথার ওপর দিয়ে গেল গুলি। ঝট করে মাথা নুইয়ে ফেলল লোকটা। ববের দিকে বন্দুকটা ছুঁড়ে দিয়ে গুলিভর্তি আরেকটা তুলে নিল কিশোর। আবার গুলি করল সারেঙকে। আর্তনাদ করে উঠে পড়ে গেল লোকটা, আস্তে আস্তে উঠল আবার। এক হাত দিয়ে আরেক হাত চেপে ধরে রেখেছে, বেকায়দা ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে আছে আহত হাতটা। যাক, একটা গুলি অন্তত খেয়েছে।
সুইভেল-গানের গুলি বর্ষণের পর পরই শূন্য হয়ে গেছে ডেক, আবার নিচে গিয়ে লুকিয়েছে সবাই।
থামো, আদেশ দিল ওমর। আন্দাজে গুলি করো না আর। ভালমত দেখে নিশানা করে তবে। ব্যাটারা বেরোক।
কিন্তু আর বেরোল না কেউ।
কাছে চলে আসছে ট্রলার, শিগগিরই ঘাটে লাগবে। এখুনি কিছু একটা করতে না পারলে আর সময় পাওয়া যাবে না।
টেনেহিঁচড়ে একটা কামানকে একেবারে কিনারে নিয়ে এল ওমর, তাকে সাহায্য করল অন্য তিনজন। জাহাজটা এসে চাপ দিয়ে চ্যাপ্টা করে দিল ঘাটে বাঁধা নৌকাকে। চত্বরের এক জায়গায় নিচু দেয়াল, ছাতে যেমন আছে, মাঝে মাঝে ফোকর। দেয়ালের নিচেই এখন জাহাজটা। ওমরের উদ্দেশ্য বুঝতে পারল না অন্যেরা। কোন ফোকরে ঢুকিয়েই এখন কামান দাগা যাবে না। তাহলে?
কামানের নল কোন ফোকরে ঢোকাল না ওমর, দেয়াল সই করে দিল বারুদে আগুন ধরিয়ে। বিস্ফোরণের গরম ঝাঁপটা যেন ছ্যাকা দিয়ে গেল অভিযাত্রীদের, কালো ধোঁয়া ঢেকে দিল সামনেটা। ধোঁয়া সরে যেতে দেখা গেল, দেয়ালের বড় একটা অংশ ধসে গিয়ে পড়েছে জাহাজের ডেকে। চেঁচামেচি আর গোঙানিতে ভরে গেছে বাতাস, মাঝে মাঝে রাইফেল গর্জে উঠছে, পাথরে বাড়ি খেয়ে শিস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে বুলেট।
লড়াইয়ের উন্মাদনায় পাগল হয়ে উঠেছে বব, তার জীবনে এত উত্তেজনা আর কখনও আসেনি। উল্লাসে চেঁচাচ্ছে সে।
ভাঙা দেয়ালটার দিকে স্থির চোখে চেয়ে আছে কিশোর। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ওমর ভাই, আসুন!
কিশোরের উদ্দেশ্য বুঝতে পারল ওমর, সে নিজেও একই কথা ভাবছিল। অন্য দুজনকে ডেকে বলল সাহায্য করতে।
হেঁইও, হেঁইও, করে ধাক্কা দিয়ে কামানটাকে ঠেলে দিল ওরা চত্বরের বাইরে।
ক্ষণিকের জন্যে বাতাসে ঝুলে রইল ভারি লোহার তাল, তারপর ডিগবাজি খেয়ে নেমে গেল নিচে। পড়ল গিয়ে জাহাজের ডেকে। ঠেকাতে পারল না ডেক এত ভারি একটা জিনিস, ভোতা শব্দ তুলে ছিঁড়ে গেল, যেন তুলট কাগজ, মস্ত কালো ফোকর সৃষ্টি করে ডেকের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল কামানটা। ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। জাহাজ।
যা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জনা ছয়েক লোক নিয়ে ডেকে বেরিয়ে এল হ্যামার। খৈ ফুটছে তার মুখে, বিচ্ছিরি সব গাল দিয়ে চলেছে অনর্গল। সৈন্যদেরকে নিয়ে সিঁড়িতে উঠে পড়ল সে।
মাসকেট! চেঁচিয়ে উঠল ওমর। থাবা দিয়ে তুলে নিল হাতের কাছে পড়ে থাকা একটা বন্দুক। হ্যামারকে সই করে দিল ট্রিগার টিপে। গুলি ফুটল না। বারুদ ভরা হয়নি বোধহয় ঠিকমত।
এই সুযোগে সিঁড়ির আধাআধি উঠে চলে এল হ্যামার, দাঁত বেরিয়ে পড়েছে কুৎসিত ভঙ্গিতে-মুখব্যাদান করে রেখেছে যেন একটা জানোয়ার, হাতে রিভলভার।
বন্দুকটা ছুঁড়ে মারল ওমর। হ্যামারের হাতে বাড়ি লেগে রিভলভারটা উড়ে গিয়ে পড়ল পানিতে।
থামল না হ্যামার। গাল দিয়ে উঠে এক টানে ছুরি বের করল। দুপদাপ করে লাফিয়ে উঠে আসছে।
সাংঘাতিক একটা মুহূর্ত। কি ঘটে কি ঘটে! এদিক ওদিক তাকাল ওমর, একটা পিস্তল দেখে ছোঁ মেরে তুলেই গুলি চালাল। তাড়াহুড়োয় গুলি লাগাতে পারল না হ্যামারের গায়ে, কিন্তু একেবারে মিস হলো না, তার পেছনের লোকটা আর্তনাদ করে উল্টে পড়ে গেল।
এবার? এবার কি হবে?