কামানের মুখ ঘোরাতে ঘোরাতে ববের মনে হলো, তিনশো বছর পিছিয়ে গেছে। সে, রক্তে লড়াইয়ের উন্মাদনা। নিজের অজান্তেই নিজেকে জলদস্যু ভাবতে শুরু। করেছে।
আচ্ছা শিক্ষা হয়েছে গতকাল, বলল ওমর, দেখছ, কেমন লুকিয়ে আছে? কারও ছায়াও দেখা যাচ্ছে না।
এসব কামানের রেঞ্জ কত, বলতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
নাহ্, মাথা নাড়ল ওমর। এত পুরানো জিনিস ছুঁয়েও দেখিনি কোন দিন।
জাহাজ সই করে দিন না তাহলে মেরে। কত দূরে যায়, এক গোলাতেই বুঝে যাব।
ঠিক বলেছ, সায় দিল ওমর। সরো, আমি গোলা ছোঁড়ার সময় কাছে থাকবে না। কি পরিমাণ ঝাঁকি দেবে কে জানে। পাগলা ঘোড়ার মত লাফিয়ে উঠলেও অবাক হব না। একটা কামানের পেছনে বসে পড়ল ওমর। আগের দিনই গোলা ভরে রেখেছে। আগুন, কিশোর, জলদি। কামানের মুখ সামান্য সরিয়ে জাহাজের। দিকে নিশানা করল।
কম্বল ছিঁড়ে সলতে বানানোই আছে। একটাতে আগুন ধরিয়ে এগিয়ে এল কিশোর। ওমর ভাই, দিন না, পয়লাটা আমিই করি। কিভাবে করতে হবে শুধু দেখিয়ে দিন।
কিশোরের দিকে চেয়ে কি ভাবল ওমর, সে-ই জানে। হাসি ফুটল মুখে। বেশ, তবে খুব সাবধান। ওই ভোজালিটা আনো। ওটার মাথায় সলতে রেখে লাগিয়ে দাও বারুদে। দিয়েই সরে যাবে এক পাশে।
তৈরি হলো কিশোর।
ফায়ার! চেঁচিয়ে আদেশ দিল ওমর।
কামানের মুখ দিয়ে ছিটকে বেরোল কমলা আগুন, পেছনে ঘনকালো ধোঁয়ার মেঘ, বাজ পড়ল যেন ঠিক কানের কাছে, এত প্রচণ্ড শব্দ। দ্বীপের পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলল সে আওয়াজ। জাহাজটা এখন কোয়ার্টার মাইল দূরে, ওটার পেছনে পানিতে পড়ল গোলা, চারিদিকে ছিটকে উঠল পানি।
গেছিল, কামান ছুঁড়তে পারার আনন্দে ধেই ধেই করে এক পাক নেচে নিল কিশোর। আরেকটু হলেই লেগে গিয়েছিল। ওমর ভাই, কামানের মুখ সামান্য নামিয়ে দিন, পরের বারেই লাগিয়ে দেব।
মুসা আর ববকে খালি কামানে আবার গোলা-বারুদ ভরার নির্দেশ দিয়ে পাশের কামানটার কাছে বসল ওমর। দেখে নিল সব ঠিকঠাক আছে কিনা। কিশোরকে আগুন আনতে বলে সরে গেল।
ফায়ার! আবার আদেশ দিল ওমর।
বুমম!
আবার কমলা আগুন ছুটে গেল জাহাজের দিকে। এবার আর মিস হলো না। ট্রলারের পেছনে কাঠ ভাঙার শব্দ হলো, শূন্যে লাফিয়ে উঠল কাঠের চিলতে।
লাগিয়েছি! লাগিয়েছি। আবার নাচতে শুরু করল কিশোর, সেই সঙ্গে হাততালি।
এতে চলবে না, ওমর সন্তুষ্ট নয়। ইঞ্জিনরুমে ঢোকাতে হবে, কিংবা পাশে এমন জায়গায় ছিদ্র করে দিতে হবে, যাতে পানি ঢোকে। দেখি, এসো। আরেকটা কামানের কাছে এসে বসল সে।
প্রথমটায় গোলা-বারুদ ভরে ফেলেছে বব আর মুসা, দ্বিতীয়টায় ভরতে লেগে গেল। এ-কাজে ওস্তাদ হয়ে গেছে দুজনে।
কামানের নিশানা ঠিক করল ওমর, তিনটেরই। মুসা আর ববকেও কামান। দাগার জন্যে তৈরি হতে বলল।
তিনজনেই তৈরি।
আবার আদেশ দিল ওমর, রেডি। ফায়ার!
কামানের গর্জনে কেঁপে উঠল পাথরের দুর্গ, কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। কালো ধোঁয়া ঢেকে দিল সামনেটা, জাহাজ দেখা যাচ্ছে না। দেখার অপেক্ষা করলও না ওরা, দ্রুতহাতে গোলা-বারুদ ভরতে শুরু করল আবার।
কালো ধোঁয়া সরে গেছে। জাহাজের দিকে চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল তিন। কিশোর, একই সঙ্গে। আনন্দে লাফাচ্ছে।
মাস্তুল গেছে, বলল বব।
ঠিকই বলেছে। মাস্তুল ভেঙে পড়েছে সামনে ডান পাশে। আগের দিনের পালের জাহাজ হলে থেমেই যেত, কিন্তু আধুনিক ট্রলার ইঞ্জিনে চলে। থামল না, কিন্তু লক্ষ্য ঠিক রাখতেও পারল না, জাহাজের নাক সোজা রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সারেঙ। কেন গোলমাল হচ্ছে, বুঝতে পারছে জাহাজের লোকেরাও, তিনজন কুড়াল হাতে এসে কোপাতে শুরু করল। মাস্তুলের গোড়ার দিকটা পুরোপুরি ছিন্ন হয়নি, সেটা কেটে পানিতে ফেলে দেবে মাস্তুলটা। আরও ক্ষতি হয়েছে জাহাজের, মূল কাঠামোর এক জায়গায় লেগেছে আরেকটা গোলা, ভেঙে গেছে। মাস্তুলের ভারে এক পাশে বিশ্রীভাবে কাত হয়ে গেছে ট্রলার।
মাসকেট! গর্জে উঠল ওমর। যারা মাস্তুল কাটছে, খতম করে দাও। হাল কাজ করছে না মনে হচ্ছে, মাস্তলটা সরাতে না পারলে করবেও না।
একনাগাড়ে গুলি চালিয়ে গেল চারজনে। কার গুলি লেগে, বোঝা গেল না, পড়ে গেল তিনজনের একজন। আরেকজন পালাল। তৃতীয়জন বড় বেশি দুঃসাহসী, মারাত্মক গুলি উপেক্ষা করে কুপিয়ে চলল।
মাসকেট ফেলে দিয়ে সুইভেল-গানের মুখ ঘোরাল ওমর। গুলি করল।
ভয়ানক ক্ষতি করল বলের ঝাঁক, কাঠের চিলতের ঝড় উঠল ডেকের একটা অংশে। তৃতীয় লোকটাও পড়ে গেল। কিন্তু দুই-এক গড়ান দিয়েই আবার উঠে পড়ল, মরেনি, আহত হয়েছে। ক্রল করে চলে গেল আড়ালে।
আজ দ্বিতীয় দফা অবাক হলো ওমর সুইভেল-গানের প্রচণ্ড ধ্বংস-ক্ষমতা দেখে। বাপ রে বাপ, শেলের চেয়ে খারাপ! বিড়বিড় করল সে।
ট্রলারের বারোটা বেজেছে, বলল মুসা।
জাহাজের গতিপথ ঠিক নেই, ইঞ্জিন চালু রয়েছে এখনও, কিন্তু নাক ঘুরে গেছে আরেকদিকে। দাঁড়িয়ে থাকার সাহস নেই সারেঙের, বসে পড়েছে, সেই অবস্থায়ই জাহাজ সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে, পারছে না।
কামান দাগতে থাকো, কিশোর আর মুসাকে আদেশ দিল ওমর। আমার বলার জন্যে বসে থেকো না। গোলা ভরো আর ছাড়ো। বব, মাসকেটগুলো ভরো তুমি।
একের পর এক গোলা ছুটল। সুইভেল-গান থেকে গুলি ছুঁড়ছে ওমর। গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে জাহাজের গা, চামড়া ক্ষত করে দিচ্ছে সুইভেল-গানের বল। জাহাজের ডেকে আর পানিতে কাঠের চিলতের ছড়াছড়ি। কিন্তু চেষ্টা করেও সারেঙের গায়ে লাগানো যাচ্ছে না, লোকটার ভাগ্য ভাল। নিরস্তও হচ্ছে না সে। এত গোলাগুলির মাঝেও হাল ছাড়ছে না। নড়াচড়ায় মাস্তুলটা আপনা-আপনি গড়িয়ে পড়ে গেছে পানিতে। ফলে জাহাজের নাক সোজা করে ফেলেছে আবার সারেঙ, এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে।