সামলে নিল আবার সৈন্যরা। কারও দাঁড় পানিতে পড়ে গিয়েছিল, কারও বা নৌকার পাটাতনে, তাড়াতাড়ি তুলে নিয়ে দ্বিগুণ বেগে দাঁড় বেয়ে ছুটে গেল তীরের দিকে। পালাচ্ছে।
পাগলের মত হাত চালাল ওমর। ওদের পালাতে দেয়া চলবে না। সুইভেল গানে আবার বল ভরে বারুদ ঠাসছে। চোখ তুলে দেখল, তীরের কাছে চলে গেছে নৌকা। তাড়াতাড়ি সলতে লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে গুলি করল আবার।
বু-ম-ম্ করে কানফাটা গর্জন তুলে আবার তপ্ত বল ছিটাল সুইভেল-গান।
এবার আর রেহাই পেল না নৌকা, উল্টে গেল। তীরের কাছে অগভীর পানিতে মৃদু ঢেউয়ে দুলছে। জনাতিনেক সৈন্য হাত-পা ছুঁড়ছে পানিতে, বাকিরা স্থির হয়ে ভাসছে। দুর্বল ভঙ্গিতে আঙুল দিয়ে বালি খামচে খামচে নিজেকে শুকনোয় টেনে তোলার চেষ্টা করছে একজন। হ্যামারসহ আরও তিনজন ছপছপ করে হাঁটু পানি ভেঙে পড়িমরি করে উঠল ডাঙায়, উঠেই দৌড় দিল জঙ্গলের দিকে। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল পাথরের স্তূপের আড়ালে।
গুলি করো, নির্দেশ দিল ওমর। ঝাঁঝরা করে দাও নৌকার তলা, যাতে ওটা নিয়ে আর না আসতে পারে, বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে আবার মাসকেট তুলে। নিয়ে গুলি চালাল। নৌকার উপুড় হয়ে থাকা তলা থেকে কাঠের চিলতে উড়ে গেল। বল ভরে গুলি চালাল আবার। পরের পাঁচ মিনিট একনাগাড়ে গুলি চালিয়ে গেল ওরা। ওমরের প্রায় প্রতিটি গুলিই লক্ষ্যভেদ করল, অন্যদের কোন কোনটা লাগল, তবে বেশির ভাগই মিস হলো। তাদেরই কারও একটা গুলি নৌকায় না লেগে লাগল গিয়ে ক্রল করে ওঠার চেষ্টা করছে যে আহত লোকটা, তার গায়ে। পড়ে গেল সে কাদা পানিতে, স্থির হয়ে রইল।
ভয় পেয়েছে ব্যাটারা, দম নিয়ে বলল ওমর, এত খোলামেলাভাবে আর আসার সাহস করবে না, ধীরে সুস্থে মাসকেটে গুলি ভরছে সে।
দাঁত বের করে হাসল কিশোর, বারুদের ধোঁয়া লেগে কালো হয়ে গেছে মুখ। হ্যাঁ, আর ছেলেমানুষ ভাববে না আমাদেরকে। ওমর ভাই, কি মনে হয়? আবার আসবে?
আসবে তো বটেই। মরার আগে হাল ছাড়বে না হ্যামার। সব রকমে চেষ্টা করে দেখবে। আক্রমণ করে না পারলে, খাবার আর পানি আটকে দেবে। তখন আর কোন উপায় থাকবে না আমাদের, ওর কথা শুনতে বাধ্য হব।
সে তো অনেক পরের কথা, খাবার ফুরোলে তবে তো, এতক্ষণে খাবার কথা মনে পড়ল মুসার। এখুনি সুযোগ, গোটা কয়েক নারকেল ভাঙলে কেমন হয়?
রাইফেল গর্জে উঠল, একটা বুলেট এসে লাগল পাথরে, বিইঙঙ করে পিছলে বেরিয়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। ঝট করে মাথা নুইয়ে ফেলল মুসা।
অসতর্ক হলে কি হবে বুঝলে তো? ভুরু নাচাল ওমর। তখনও বোকামি করেছ দেখেছি, কয়েকবার দাঁড়িয়ে উঠেছ। ওরা ঠিকমত গুলি চালাতে পারলে তোমার নিজের নারকেলই ভেঙে পড়ে থাকত এতক্ষণে। খবরদার, আর কক্ষনো মাথা তুলবে না।
ভ্রূ-কুঞ্চিত হলো ববের। বোকার মত বলল, আমাদেরকে গুলি করছে?
তো কাকে? পাথরে হাত সই করছে? পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে আমাদের দেখলেই গুলি ছুঁড়বে। মনে হচ্ছে, এইই করবে ওরা আপাতত। যাও, তাড়াতাড়ি গিয়ে কিছু মুখে দিয়ে এসো। আমি পাহারায় থাকছি। তোমরা এলে আমি যাব।
বিকেল গড়িয়ে গেছে। ছেলেরা যখন ফিরে এল, পশ্চিমে হেলে পড়েছে, তখন সূর্য। শত্রুদের দেখা যাচ্ছে না, তবে মাঝেমধ্যে একআধটা বুলেট ছুটে এসে আঘাত হানছে পাথরের দেয়ালে। কারও কোন ক্ষতি করতে পারছে না। এটা বোঝা যাচ্ছে, দুর্গের দিকে কড়া নজর রেখেছে শত্রুরা।
রাত নামল। চারজন সৈন্য ছুটে এল উল্টোনো নৌকাটার দিকে। তারার আলোয় তাদের আবছা মূর্তি লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল অভিযাত্রীরা। যেমন এসেছিল, তেমনি তাড়াহুড়ো করে আবার ফিরে গেল সৈন্যরা।
রাত গম্ভীর হলো। সৈন্যদের সাড়া নেই আর। কাউকে দেখা গেল না।
কড়া পাহারা দিতে হবে আজ রাতে, ওমর বলল সঙ্গীদেরকে। ঘুমোতে হবে এখানে শুয়েই। বব, আজও দ্বীপে যাবে নাকি?
মাথা খারাপ! জোরে মাথা নাড়ল বব।
নয়
ভোর হলো। ববের এখন ডিউটি। সাগরের ওপর হালকা কুয়াশা, ধোয়ার চাদর ঢেকে রেখেছে যেন দ্বীপটাকে। সূর্য উঠল। এক ঝটকায় সরিয়ে নিয়ে গেল ঝুলে থাকা কুয়াশা। চেঁচিয়ে উঠল বব তীক্ষ্ণ কণ্ঠে, এই, তোমরা জলদি এসো! ওমর ভাই! জলদি আসুন।
ছুটে এসে উঠল সবাই ছাতে।
কি ব্যাপার? কি হয়েছে? চোখ ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করল ওমর।
খোলা সাগরের দিকে আঙুল তুলে দেখাল বব। আয়নার মত সমতল সাগর, কাঁচা রোদে চিকচিক করছে। তাতে ঢেউ তুলে আস্তে আস্তে দুর্গের দিকে এগিয়ে আসছে ট্রলারটা, আগের দিন যেটাকে ল্যাগুনের কাছে দেখা গিয়েছিল। গলুইয়ের নিচে পানি ছিটকে পড়ছে দুদিকে, পানির ছোট ছোট কণাগুলোতে রোদ লাগায় মনে হচ্ছে হীরের টুকরো। শিল্পীর তুলিতে আঁকা যেন এক অপরূপ ছবি, কিন্তু ওমরের তা মনে হচ্ছে না। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসছে সুন্দর জাহাজটা।
তাহলে এই ব্যাপার, বিড়বিড় করল ওমর। জাহাজ থেকে আক্রমণ চালাবে।
সারেঙ ছাড়া তো আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না, দেখতে দেখতে বলল কিশোর।
নিশ্চয়ই নিচে রয়েছে, যাতে গুলি না করতে পারি আমরা। থাকুক। সুইভেল গানটার কথা জেনে গেছে ওরা, কিন্তু কামানের কথা জানে না এখনও
সই করে দুএকটা গোলা জাহাজে ফেলতে পারলেই কাঁপিয়ে দিতে পারব। শোনো, ভারি হলো ওমরের কণ্ঠ, এ-যাবৎ ডাকাত-ডাকাত খেলা খেলে এসেছি, কিন্তু এটা খেলা নয়। প্রাণপণে লড়তে হবে এবার। হ্যামারের হাতে পড়া চলবে না। তার শয়তানীর সাক্ষী আমরা, তাকে খুন করতে দেখেছি। সাক্ষী বাঁচিয়ে রাখতে চাইবে না সে কিছুতেই। এসো, হাত লাগাও। বক্তৃতা শেষ করল সে। কোমরের পিস্তল খুলে নিয়ে তাতে বারুদ আর গুলি ভরল। চলো, কামানের মুখ ঠিক করে রাখি।