একটা অফার দিতে এসেছি, বলল হ্যামার।
বলো।
মোহরগুলো দিয়ে দাও, বিনিময়ে তোমাদেরকে ম্যারাবিনায় পৌঁছে দেব।
হাসল ওমর। ধন্যবাদ। ম্যারাবিনায় যাব না।
মোহরগুলো দেবে না? রেগে উঠছে হ্যামার।
যা পেয়েছ পেয়েছ, আর একটাও না।
ঠিক আছে, দাঁতে দাঁত চাপল হ্যামার। ধরে এমন ধোলাই দেব, গলার এই জোর থাকবে না। বলতে দিশে পাবে না, কোথায় রেখেছ মোহর।
ধোলাই তো পরের কথা, আগে ধরতে হবে তো আমাদের?
শাআলা! গাল দিয়ে উঠল হ্যামার। দাঁড়া, আগে ধরি, জ্যান্ত ছাল ছাড়িয়ে নেব। মুখ খিস্তি করে আরও কয়েকটা গাল দিল সে, ঘুসি পাকিয়ে হাত ঝাঁকাল বার কয়েক। দুপদাপ করে নেমে ছুটে গেল নিজের লোকজনের কাছে। মিনিটখানেক পর তিনজন সৈন্য রাইফেল হাতে ছুটে গেল ট্রলারের দিকে।
কি করতে চায়? নিচু কণ্ঠে বলল কিশোর।
নৌকা নিয়ে আসবে মনে হচ্ছে, বলল ওমর। লড়াই করতেই হচ্ছে। চত্বরে তূপ করে রাখা হয়েছে চকচকে সোনালি মোহরগুলো। তেমন বুঝলে সব মোহর পানিতে ফেলে দেব, তবু ব্যাটাদেরকে দেব না। চলো, রেডি হই। ছাত থেকে নেমে বলল সে, আমাদের কাছে মাসকেট আছে, জানে হ্যামার, কিন্তু ওগুলোর খবর জানে না, হেসে কামানগুলো দেখাল। সুইভেল-গানটার কথাও জানে না। পয়লা চোটেই ওদেরকে ভয় পাইয়ে দিতে হবে।
কাজে লেগে গেল চার অভিযাত্রী। কড়া রোদ মাথার ওপরে। দরদর করে ঘামছে ওরা, কামান-বন্দুকে বারুদ ঠাসছে। পাঁচ পাউণ্ড ওজনের একটা গোলা তুলে নিয়ে বলল মুসা, এটা যদি লাগে হ্যামার মিয়ার মুখে? ডেনটিস্ট দেখানোর আর দরকার পড়বে না! বলেই ঢুকিয়ে দিল একটা কামানে।
তার রসিকতায় হাসল অন্যেরা।
বেজায় ভারি সুইভেল-গানটা। নিচ থেকে এনে প্রণালীর দিকে নিশানা করে বসাতে গিয়ে ঘামে চুপচুপে হয়ে গেল একেকজন। বারুদের পিপা, গুলি, পিস্তল বন্দুক, এমনকি ছুরি-বল্লম যা আছে, সব নিয়ে আসা হলো ওপরে, হাতের কাছে রাখা হলো। এভাবে দেখল ওমর, ওভাবে দেখল, সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে।
আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়? প্রস্তাব রাখল কিশোর। লুই। ডেকেইনির নিশানটা উড়িয়ে দিই?
খুব ভাল হয়, আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠল বব। দারুণ হয়।
ভাল বলেছ, হাসিতে ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়ল মুসার।
মন্দ বলোনি, ওমরও হাসছে।
ববের উৎসাহই বেশি। ছুটে নিচে গিয়ে কালো পতাকাটা নিয়ে এল সে। নৌকার দাঁড়ের মাথায় বেঁধে উড়িয়ে দিল ছাতের ওপরে। সুর করে গেয়ে উঠল ট্রেজার আইল্যাণ্ডের জলদস্যুদের সেই বিখ্যাত গান, ফিফটিন মেন অন দ্য ডেড ম্যানস চেস্ট, ইয়ো হো হো, অ্যাণ্ড আ বটল অভ রাম।
ববের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কোরাস গাইল অন্যেরা: ড্রিংক অ্যাণ্ড দ্য ডেভিল হ্যাড ডান ফর দ্য রেস্ট, ইয়ো হো হো, অ্যাণ্ড আ বটল অভ রাম।
ফোকর দিয়ে দেখল কিশোর, এদিকেই চেয়ে আছে সৈন্যরা। মুখের ভাব বোঝা যাচ্ছে না দূর থেকে, কিন্তু তাজ্জব যে হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ওরা ভাবছে, আমরা পাগল হয়ে গেছি।
ভুল ভাবছে? হাসিতে উজ্জ্বল ওমরের মুখ। হঠাৎ সাগরের দিকে চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে বলল, মাথা নামাও! ওরা আসছে।
ল্যাগুনের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এগিয়ে আসছে একটা নৌকা, দাঁড় টানছে চারজন লোক। তীর ঘেঁষে চলছে। গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা। হ্যামারকে মাথা নিচু করে সেদিকে ছুটে যেতে দেখা গেল। খানিক পরে আড়াল থেকে আবার বেরিয়ে এল নৌকাটা।
কতজন? বিড়বিড় করল কিশোর।
চোদ্দ-পনেরোজন হবে, আন্দাজ করল ওমর।
দ্বীপের চোখা প্রান্তের কাছে চলে এল নৌকা। লোকের ভারে প্রায় ডোবে। ডোবে। বার বার হাত ঝাঁকি দিয়ে কি যেন বলছে হ্যামার, বোধহয় আরও জোরে দাঁড় টানতে বলছে।
আমি না বললে গুলি করবে না, নিচু গলায় নির্দেশ দিল ওমর।
আরও এগিয়ে এল নৌকা।
হঠাৎ আদেশ দিল ওমর, ফায়ার!
গর্জে উঠল মাসকেট, বার বার তীরের পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো বিকট আওয়াজ। নৌকার পাশের পানি ছিটকে উঠল গুলি লেগে। পাটাতনে নুয়ে পড়ে গেল নৌকার একজন। কিন্তু দাঁড় বাওয়া থামাল না ওরা, দ্রুত এগিয়ে এল।
গুলি করো, আদেশ দিল আবার ওমর। থেমো না।
আরও দুজন সৈন্য পড়ে গেল। দুহাত শূন্যে তুলে লাফিয়ে উঠল একজন, বাঁকা হয়ে পানিতে পড়ল ঝপাং করে। একবার কাত হয়ে আবার সোজা হলো নৌকাটা, থামল না, এগিয়ে আসছে আরও দ্রুত।
মাসকেট ফেলে সুইভেল-গানের কাছে চলে এল ওমর। নৌকার দিকে নল ফেরাতে ফেরাতে অদ্ভুত হাসি ফুটল মুখে। টাচ-হোলে কিছু আলগা বারুদ ঢেলে। দিয়ে কম্বল-ছেঁড়া বানানো সলতেয় আগুন ধরিয়ে দাগল কামান। নলের মুখ দিয়ে ঝলকে বেরোল আগুন, আগুনের ফুলঝুরি ছিটিয়ে ছুটে গেল এক ঝাঁক বল। প্রচণ্ড শব্দে কানের পর্দা ফেটে গেছে মনে হলো অভিযাত্রীদের, কামানের নলের সামনে কালো ধোঁয়ার মেঘ।
প্রতিক্রিয়া দেখে বোবা হয়ে গেল যেন ওমর। এত জোরে পিছু-ধাক্কা দেবে সুইভেল-গান, কল্পনাও করেনি সে। প্রায় শখানেক বল ভরে দিয়েছিল, সব ছুটে গেছে ঝাঁক বেঁধে। টগবগ করে ফুটতে শুরু করল যেন কিছুটা জায়গায় পানি, আরেকটু হলেই গিয়েছিল উল্টে নৌকা। সৈন্যদের গোঙানি আর আতঙ্কিত চিৎকার শোনা গেল। চারজনের মাত্র একজনের হাতে দাঁড় রয়েছে, কিন্তু ওই তাণ্ডবের মাঝে সে-ও বাইতে পারছে না, কিংবা বাওয়ার কথা ভুলেই গেছে। সব শব্দ ছাড়িয়ে শোনা যাচ্ছে হ্যামারের কুৎসিত গালাগাল। ধাক্কার চোটে নৌকার নাক ঘুরে গেছে আবার। যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে।