যাক, বাবা, সারলাম, বাঁচা গেল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওমর। কিন্তু হ্যামারের পাত্তা নেই কেন? কি করছে? একটা শব্দ শোনা গেল। ওই যে সাড়া বোধহয় মিলল। বব, এক দৌড়ে গিয়ে দেখে এসো তো।
সৈকতে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল বব। হাঁ করে চেয়ে রইল এক মুহূর্ত, তারপর ঘুরে দৌড় দিল। দূরে থাকতেই চেঁচিয়ে বলল, জলদি আসুন, জলদি! পালাতে হবে! নৌকার দিকে ছুটল সে।
পাথরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল তিনজনে। কি হয়েছে? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল ওমর।
সৈন্য! জবাব দিল বব। ম্যারাবিনা থেকে সৈন্য নিয়ে এসেছে, কণ্ঠে আতঙ্ক, অনেক সৈন্য। এদিকেই আসছে ওরা।
আর দেরি করল না ওমর। ছোঁ মেরে মাসকেট তুলে নিল, হাত বাড়াল। বালতির দিকে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বালতিতে পা লাগিয়ে টান মেরে বসল কিশোর, কাত হয়ে পড়ে গেল বালতি, ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত মোহর। কুড়িয়ে তুলতে গেল আবার ওগুলো।
রাখো রাখো, বলে উঠল ওমর। তোলার সময় নেই। জলদি নৌকার দিকে দৌড় দাও।
নৌকা পানিতে নামিয়ে দাঁড় হাতে তৈরি হয়ে আছে বব। কিশোর আর মুসা। উঠল। গভীর পানিতে নৌকা ঠেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠে বসল ওমর। এক পাশে কাত হয়ে বেশ খানিকটা পানি উঠল নৌকায়, উল্টে যাচ্ছিল প্রায়।
পাথরের স্তূপের কাছ থেকে শোনা গেল সম্মিলিত চিৎকার। ওদের দেখে ফেলেছে সৈন্যরা। খানিকক্ষণ পর আবার শোনা গেল চিৎকার।
মোহরগুলোও দেখেছে, ববের হাত থেকে দাঁড় নিয়ে জোরে জোরে বাইতে শুরু করল ওমর।
কিশোরের ছড়িয়ে ফেলা মোহরগুলোই প্রাণ বাঁচাল ওদের। রাইফেলের নিশানা করে ফেলেছিল কয়েকজন সৈন্য, ট্রিগার টিপতে যাবে, এই সময় তাদের কানে এল, মোহর! মোহর! চিৎকার। অন্যেরা লুটছে, তারাই বা বাদ পড়ে কেন? ছুটল তারাও। গিয়ে দেখে সত্যি মোহর কুড়াচ্ছে তাদের সঙ্গীসাথীরা, রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে তারাও কুড়াতে লেগে গেল। হ্যামারের শত চিৎকারেও কান দিল না কেউ।
ইমেট চাবের অটোমেটিকটা নিয়ে নিয়েছিল হ্যামার, ওটা নিয়েই ছুটে এল সৈকতে। রাগে, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে, হাত ঠিক রাখতে পারল না, এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ল, নৌকার ধারেকাছে এল না একটাও।
সব মোহর কুড়িয়ে পকেটে ভরল সৈন্যরা, আর একটাও পড়ে রইল না। রাইফেল তুলে নিয়ে ফিরে এল আবার সৈকতে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দূরে চলে এসেছে নৌকা। গুলি করল সৈন্যরা, দুএকটা বুলেট নৌকার একেবারে কাছে পানি ছিটাল, কিন্তু লাগল না কারও গায়ে।
গুলি করো, কিশোর, বলল ওমর। কারও গায়ে লাগুক না লাগুক, ভয়। দেখাও।
গর্জে উঠল কিশোরের মাসকেট। প্রচণ্ড ধাক্কা লাগল। এত ধাক্কা দেবে কল্পনাও করেনি সে, বাঁকা হয়ে গেল এক পাশে। পাথরে বাড়ি লেগে বিকট শব্দ তুলে সৈন্যদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল বল। চোখের পলকে ডাইভ দিয়ে আড়াল। নিল ওরা। ওখান থেকে গুলি ছুঁড়তে থাকল একনাগাড়ে।
নিরাপদেই সিঁড়ির গোড়ায় এসে ভিড়ল নৌকা।
জলদি উঠে যাও, বলল ওমর। একবারে একজন করে।
লাফিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে এল তিন কিশোর। ঘাটের কাছে নৌকাটাকে শক্ত করে বেঁধে ওমরও উঠে এল। হাউফফ, করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বসে পড়ল অন্যদের পাশে, একটা নিচু পাথরের দেয়ালের আড়ালে। বড় বাঁচা বেঁচেছি। কিন্তু ব্যাটারা এল কিভাবে?
ছাতে উঠল ওমর, হামাগুড়ি দিয়ে চলে এল কিনারে। সাবধানে উঁকি দিল। যা দেখার দেখে পিছিয়ে এসে বলল, অবস্থা ভাল না।
কি? জানতে চাইল কিশোর।
জাহাজ নিয়ে এসেছে ব্যাটারা, সাইজ দেখে মনে হলো ট্রলার। কোস্ট গার্ডদের বোধহয়। কিন্তু জানল কিভাবে…
বারডু, সিডনি বারডু, বলল কিশোর। ও-ই গিয়ে খবর দিয়েছে ম্যারাবিনায়, সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিল নিশ্চয়ই হ্যামার। অ্যালেন কিনি মরেছে বটে, কিন্তু তার দোসরগুলো তো আছে। কোটার চেয়ে কোনটা কম শয়তান না।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, তর্জনী নাড়ল ওমর। ইউনিফর্ম পরা ওই শয়তানটাকেও দেখেছি সৈন্যদের সঙ্গে, ওই যে ওই অফিসারটা, যেটা এসে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আমাদেরকে।
কতজন আছে?
ঠিক বোঝা গেল না, তিরিশ-চল্লিশ কিংবা তার বেশিও হতে পারে।
হুঁ। ভাগ্যিস, নারকেলগুলো এনে রেখেছিলাম। আরি… শব্দ শুনে ফিরে তাকাল কিশোর।
বারডু! বারডু আসছে, চেঁচিয়ে বলল মুসা। হাত তুলে দেখাল, দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উড়ে আসছে বিমানটা।
কপালে হাত রেখে দেখল ওমর, মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, আমাদের উভচরটাই সহজে ছাড়বে না, বোঝা যাচ্ছে।
ছাতে উঠে এল চারজনেই, নিচু দেয়ালের ছোট ছোট ফোকর (বন্দুকের নল ঢুকিয়ে শত্রুদের ওপর গুলি চালানোর জন্যে তৈরি হয়েছে ফোকরগুলো) দিয়ে দেখছে। সৈকত থেকে সামান্য দূরে জঙ্গলের ছায়ায় গিয়ে বসেছে সৈন্যরা। হাত নেড়ে তাদেরকে কি যেন বলছে হ্যামার।
ফিরল হ্যামার। এগিয়ে এল সৈকত ধরে। দুর্গের দিকে চোখ।
কি ব্যাপার? বিড়বিড় করল ওমর।
আরি, মিল করতে আসছে মনে হয়! অবাক কণ্ঠে বলল কিশোর।
হ্যামারের হাতে একটা লাঠি, মাথায় সাদা কাপড় বাধা। পানির একেবারে কিনারে এসে উঁচু একটা পাথরে চড়ল, লাঠিটা মাথার ওপর তুলে কাপড় নাড়ল জোরে জোরে। চেঁচিয়ে বলল, এই, শুনছ? এইই, তোমরা?
আমাকে কভার দাও, ছেলেদেরকে বলল ওমর, আমি বললেই গুলি চালাবে। হ্যামারকে বলল, কী? চেঁচাচ্ছ কেন?