বাইরের কেউ নয়, ওমর। ববকে নড়াচড়া করতে দেখে বলল, উঠে পড়ো। বেরোনোর সময় হয়েছে।
এখনও ভোর হয়নি, না?
হয়নি, তবে হবে। তারার আলো কমে গেছে, পাঁচ মিনিট পরেই তোর আলো ফুটবে। আরে এই, মুসা, আবার শুয়ে পড়লে যে? ওঠো, ওঠো, নারকেল ভেঙে নাস্তা সেরে নাও। আমি বন্দুকগুলো গুছিয়ে নিই।
হাই তুলতে তুলতে উঠে বসল মুসা। দরকার পড়বে?
শত্রু যখন রয়েছে, পড়তেও পারে।
কিশোর কই?
ছাতে, পাহারা দিচ্ছে, নাস্তাও সেরে নিচ্ছে। জলদি করো, রেডি হয়ে নাও।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। হায়, আল্লাহ, মোহরের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ওগুলো আনতে যাচ্ছি আমরা?
হ্যাঁ। ওগুলোও আনতে হবে।
নারকেল ভাঙল মুসা। ঢকঢক করে পানি খেলো। নারকেল সুদ্ধ অর্ধেকটা মালা ববকে দিয়ে বাকি অর্ধেকটা দিতে গেল ওমরকে।
আমি খেয়েছি, বলল ওমর। তোমরা জলদি সেরে নাও।
নৌকায় বসেই খেতে পারব, চলুন যাই, মুসা বলল।
চত্বরে বেরিয়ে কিশোরকে ডাকল ওমর, ছাত থেকে নামতে বলল। ফ্যাকাসে নীল হয়ে গেছে আকাশ, পুব দিগন্তে লালচে আলো। সূর্য উঠবে। কি ভেবে ছাতে উঠে গেল ওমর। ল্যাগুন আর তার আশপাশে যতদূর দেখা যায়, দেখল। হ্যামারকে দেখা যাচ্ছে না, উভচরটাও না। ফেরেনি সিডনি বারভু।
একটা করে মাসকেট নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা, নৌকায় উঠল।
পাঁচ মিনিটে পেরিয়ে এল প্রণালী, পাথরের খাঁজে তুলে রাখল নৌকাটা।
বব আর কিশোরকে দাঁড়াতে বলল ওমর। মুসা, তুমি আমার সঙ্গে এসো।
কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কাজ আছে, সেরে ডাকব। তোমরা পাহারা দাও। হ্যামারকে দেখলে জানাবে।
একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল কিশোর। কি কাজ সারতে গেছে ওমর ভাই, অনুমান করতে পারছে। কিছুক্ষণ পর উল্টো দিকে পানিতে ঝপাং করে শব্দ হতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
ভাল, বিড়বিড় করল সে, ইমেট চাবের লাশ আর দেখতে হলো না আমাকে। সোনার লোভ কত মানুষের যে সর্বনাশ করল।
স্বর্ণ সর্বনাশ করেনি, মানুষ নিজেই নিজের সর্বনাশ করেছে, গম্ভীর হয়ে বলল বব।
ওমরের ডাক শোনা গেল। তাড়াতাড়ি উঠে ছুটল বব আর কিশোর।
বব, ওমর বলল, আগে হাঁটো, পথ দেখাও। মোহর তুমি খুঁজে পেয়েছ, আগে গর্তে নামার সম্মান তোমার প্রাপ্য।
উজ্জ্বল হয়ে উঠল ববের মুখ। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল সঙ্গীদের। গর্তটার কিনারে এসে হাত তুলে দেখিয়ে বলল, ওটা।
আল্লাহ্! সত্যিই তো, গর্তে উঁকি দিয়ে দেখে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ওমর।
হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কিশোর আর মুসার মুখ।
লাফিয়ে গর্তে নেমে এক মুঠো মোহর তুলল ওমর। ঠিক বলেছ তুমি, বব। কয়েক হাজারের কম না।
আরও বেশিও হতে পারে, বলল বব। গুনব নাকি?
এক মিনিট, হাত তুলল কিশোর, মাথা গরম করলে চলবে না। এখানে বসে গোনা রিস্কি হয়ে যাবে, আর গোনার দরকারই বা কি? যা আছে তো আছেই। এগুলো এখান থেকে নিতে হলে ওই দুর্গেই নিতে হবে। তারপর মোহর পাহারা দিয়ে বসে থাকতে হবে ওখানে, কতদিন কে জানে। ঝড় উঠলে, সাগরের অবস্থা খারাপ হলে বেরোতে পারব না, দ্বীপে আসতে পারব না, মোহর সামলাতে গিয়ে শেষে না খেয়ে মরতে হবে। ওদিকে হ্যামার কি করছে সে-ই জানে। চুপ করে বসে থাকার পাত্র সে নয়, নিশ্চয়ই কোন শয়তানী বুদ্ধি আঁটছে। শীঘ্রিই কিছু একটা করবে সে। আমাদের হুঁশিয়ার থাকা দরকার।
ঠিকই বলেছ, গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো ওমর। তৈরি থাকতে হবে আমাদের। মুসা, নারকেল কুড়াও গিয়ে। যত বেশি পরো, জমাও। কিশোর, জাহাজটায় যেতে পারবে আবার?
পারব। কেন?
বারুদ আনতে হবে।
আচ্ছা, মাথা কাত করল কিশোর।
বব, বলল ওমর, যাও তো, এক দৌড়ে গিয়ে বালতিটা নিয়ে এসো, ফুটো বালতিটা। মোহরগুলো নিতে হবে। আমি বাইরে তুলে রাখছি।
হ্যামার এলে? মুসা প্রশ্ন করল।
আসুক। চারজনের বিরুদ্ধে যদি লাগার সাহস থাকে, আসুক না। পকেটে অভিশপ্ত ডাবলুন, সে তো এমনিতেই মরা। যাও, তোমরা যার-যার কাজে চলে। যাও।
নারকেল কুড়িয়ে তূপ করে ফেলল মুসা। বালতি নিয়ে এলো বব। কিশোরও বারুদের পিপে নিয়ে হাজির-জাহাজে ঢোকা আর বেরোনোর পথ পেয়ে গেছে, কাজটা আর মোটেই কঠিন নয় এখন। মোহর তুলে গর্তের পাড়ে জমাচ্ছে ওমর।
সূর্য অনেক উপরে উঠেছে। কড়া রোদ। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল। ওমর, মুসা, নারকেল ভাঙবে? খুব খিদে পেয়েছে।
এখুনি আনছি, নারকেল আনতে চলে গেল মুসা।
বারুদ কতখানি আনলে? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল ওমর।
আধ পিপার বেশি। এর বেশি আর বইতে পারলাম না।
ওতেই চলবে। দুর্গেও কিছু আছে। ছোটখাট লড়াই ঠেকানো যাবে।
লড়াই হবেই? কিন্তু বুঝতে পারছি না, লড়াইটা কার বিরুদ্ধে করব? হ্যামার, তো একলা, নিজের সঙ্গেই আলোচনা করছে যেন কিশোর। যাকগে, যখন হয় তখন দেখা যাবে। এখন মোহর সরানো দরকার।
হ্যাঁ, ওমর বলল, অনেক মোহর। সরাতে সময় লাগবে। তুলছিই শুধু, শেষ আর হয় না।
নারকেল ভেঙে নিয়ে এল মুসা। গর্তের পাড়ে বসে খেলো চারজনে, জিরিয়ে নিল।
কিশোর, ওমর বলল, তুমি আর মুসা মোহরগুলো দুর্গে নিতে থাকো। আমি আর বব তুলে বালতি ভরে দিচ্ছি।
বার বার নৌকা নিয়ে আসা আর যাওয়া, বেশ পরিশ্রমের কাজ, গর্ত খুঁড়ে মোহর তোলাও কম মেহনত নয়। সময় লাগল অনেক। কিন্তু অবশেষে শেষ হয়ে এল কাজ। শেষবারের মত বালতি ভরা হলো মোহর দিয়ে। আর নেই। ওমরের অনুমান, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার মোহর নিয়ে যাওয়া হয়েছে।