জোরে ঠোঁট কামড়ে ধরল বব, অনেক কষ্টে সামলাল নিজেকে, চিৎকার করে উঠেছিল প্রায়। মনের পর্দায় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ছবি, গর্তের বাইরে কি ঘটেছে।
আমার সঙ্গে ইতরামি…আমার সঙ্গে… ভয়ংকর কণ্ঠে বিড়বিড় করল হ্যামার। হুঁহ্!
পায়ের শব্দ চলে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল বব। কিন্তু আরও মিনিট দশেক বাইরে বেরোনোর সাহস হলো না। কুঁকড়ে বসে থাকতে থাকতে হাতে-পায়ে খিল ধরার অবস্থা। অবশেষে আস্তে করে সোজা হয়ে উঁকি দিল গর্তের বাইরে। এক নজরই যথেষ্ট, দ্বিতীয় বার আর ইমেট চাবের গলাকাটা লাশটার দিকে চাওয়ার সাহস হলো না।
মোহর নেয়ার জন্যে অপেক্ষা করল না বব, পিস্তলটা খুঁজে বের করার জন্যেও থামল না আর। এক লাফে বেরিয়ে এসে সোজা দৌড় দিল নৌকার দিকে। বার দুই হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে কোনমতে সামলে নিল, পায়ের চামড়া ছড়ে গেল ধারাল পাথরে লেগে, কেয়ারই করল না। নৌকার ওপর এসে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কাঁপা আঙুলে কিভাবে দড়ি খুলল, বলতে পারবে না, নৌকাটা এনে ফেলল পানিতে। লাফিয়ে উঠে বসে দাঁড় বেয়ে তীর বেগে ছুটল। ঘোরের মধ্যে যেন পেরিয়ে এল প্রাণীটা, নৌকা বাঁধল ঘাটে, একেক লাফে দুটো তিনটে করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে এল ওপরে।
থামো! কে? বরফ-শীতল ওমরের কণ্ঠ।
আ-আমি, বব, হাঁপাচ্ছে বব।
উঠে এসো।
চত্বরে উঠে এলো বব। ছায়া থেকে বেরিয়ে এল ওমর। অন্য দুজন তার পেছনে।
কোথায় গিয়েছিলে? কঠিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ওমর।
দ্বীপে।…আ-আমি পেয়েছি… হাঁপানোর জন্যে কথা বলতে পারছে না।
ধারাল ছুরির মত কেটে বসল যেন ওমরের কথা, কি পেয়েছ সেটা পরের কথা। পাহারা ছেড়ে গিয়েছ কেন?
কিন্তু…
কোন কৈফিয়ত শুনতে চাই না। গেছ কিনা, বলো আগে।
হ্যাঁ।
অন্যায় করেছ?
হ্যাঁ।
আর কক্ষনো করবে না। ভাগ্য ভাল, কিছু ঘটেনি। কিন্তু ঘটতে পারত। সবাইকে বিপদে ফেলে দিতে পারতে।
সরি! আর এমন হবে না!
ঠিক আছে, কিন্তু এটা করলে কেন?
ডাবলুনটা আনতে গিয়েছিলাম।
কী? ধাক্কা খেয়ে যেন পিছিয়ে এল ওমর। সেই অভিশপ্ত মোহর?
হ্যাঁ। ভাবলাম…
ভাবাভাবি পরের কথা। মোহরটা এনেছ? জলদি ফেলো, ছুঁড়ে ফেলো পানিতে।
আনতে পারিনি। হ্যামার নিয়ে গেছে।
কি করে জানলে?
আমি গর্ত থেকে তুলে একটা পাথরে রেখেছিলাম। একটু পরেই হ্যামার আর ইমেট চাব এল। মোহরটা দেখে এ বলে আমি নেব, ও বলে আমি নেব। কথা কাটাকাটি শেষে ইমেট চাবের গলা ফাঁক করে দিল হ্যামার। মোহরটা নিয়ে চলে গেল।
মুসা আর কিশোরের দিকে তাকাল ওমর। কি বলেছিলাম, মোহরটা অভিশপ্ত? বদলে গেছে তার কণ্ঠস্বর, ফাসফেঁসে হয়ে উঠেছে। বউনের মোহরের জন্যে আরেকজন মরল। হ্যামার নিয়ে গিয়ে কপালে দুর্গতি টেনে আনল আর কি। ববের দিকে ফিরল আবার সে। এতক্ষণ কি করলে?
গর্তে বসেছিলাম। আরও অনেকগুলো পেয়েছি।
কি পেয়েছ?
মোহর, বোম ফাটাল যেন বব।
চুপ হয়ে গেল সবাই।
আরও মোহর পেয়েছ? বলল অবশেষে কিশোর।
হ্যাঁ।
কতগুলো?
কয়েকশো হতে পারে, কিংবা কয়েক হাজার, হাত উল্টাল বব।
শিওর? ওমর বলল।
শিওর। হাতে নিয়ে দেখেছি।
ঘুমিয়ে পড়োনি তো? ওমরের কণ্ঠে স্পষ্ট সন্দেহ। স্বপ্ন দেখেছ?
এক পা সামনে বাড়ল বব। চেঁচিয়ে উঠল, স্বপ্ন? মোটেই না। বললাম তো, হাতে নিয়ে দেখেছি।
এগিয়ে এল কিশোর। কোথায় পেলে বুব?
ওমর ভাই যে গর্তে ডাবলুনটা ফেলে দিয়েছিল। ম্যাবরির তাড়া খেয়ে ওটাতেই লুকিয়েছিলাম।
নাহ্, বিশ্বাস হচ্ছে না! গাল চুলকাল ওমর, মাথা নাড়ল আনমনে। এত সাধারণ একটা গর্তে মোহর লুকিয়েছিল ডেকেইনি?
হ্যাঁ, তাই, প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। এখন বুঝতে পারছি। ম্যাপে পাহাড় বোঝানো আছে, আঁকাবাকা লম্বা দাগ দিয়ে, দাগের এক জায়গায় ছোট একটা গোল চিহ্ন, তারমানে গর্তটা। ওই গর্তে মোহর রেখে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছিল ডেকেইনি। বব, হ্যামার আর ইমেট চাব ওখানে কি করতে এসেছিল?।
কথাবার্তা শুনে তো মনে হলো, আমাদের খুঁজতে।
কি কি বলছে, শুনেছ ভালমত?
খুব বেশি কিছু বলেনি। তবে একটা কথা জরুরী মনে হলো, আগামীকাল বেড় দিয়ে নাকি ধরবে আমাদের।
উউহ! মুখ বাঁকাল মুসা। পুকুরে জিয়ানো মাছ পেয়েছে আর কি। হারামির বাচ্চা! কিভাবে ধরবে, বলেছে?
না। তবে কথাটায় বেশ জোর ছিল। এমনভাবে বলল, যেন আগামীকাল বশেষ কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তাতে আমাদের ধরা খুব সহজ হয়ে যাবে।
চিন্তিত হয়ে পড়ল ওমর। বুঝতে পারছি না। কিভাবে আমাদের ধরবে? কছুক্ষণ আগে ছিল চারের বিরুদ্ধে দুই, এখন হয়েছে এক ম্যাবরি আহত, তাকে গানার বাইরে রাখা যায়…
মনে হয় মারা গেছে, বলে উঠল বব। ইমেট চাব বলছিল, ম্যাবরি এমন এক জায়গায় গেছে, যেখানে মোহর কোন কাজে লাগবে না তার।
অভিশপ্ত ডাবলুনের আরও শিকার, নরম গলায় বলল ওমর। ইমেটের লাশ কোথায়?
গর্তটার ধারেই পড়ে আছে।
কাল সকালেই ওকে সরিয়ে ফেলতে হবে। লাশ দেখতে ফিরে এসে না আবার মোহর আবিষ্কার করে বসে হ্যামারের বাচ্চা। এখন রাতের বেলা কিছু করতে পারব না, তবে আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগব। চলো, ঘুমিয়ে নিই। মুসা, তুমি পাহারায় থাকো। ববের মত ঘাড়ে ভূত চাপবে না তো?
হাসল মুসা। মাথা নাড়ল।
ওমর আর কিশোরের পেছন পেছন ঘরে নেমে এল বব। শুয়ে খালি এপাশ ওপাশ করতে লাগল, ঘুম এল না সহজে। ঘুমের মধ্যেও দুঃস্বপ্ন দেখল, হ্যামার আর লুই ডেকেইনি হাতে হাত মিলিয়েছে, মস্ত দুই ছুরি নিয়ে তাড়া করছে তাকে।
আট
ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বব। অন্ধকার রয়েছে এখনও, আবছা একটা মূর্তিকে নড়াচড়া করতে দেখল সে। আরও ভালমত দেখার জন্যে সোজা হয়ে বসল।