বেশি চালাকির ফল, অবশেষে বলল হ্যামার। সঙ্গীদের দিকে ফিরল, ছেলেদুটোকে কী করব?।
দাঁত বের করে হাসল নিগ্রো ম্যাবরি ভেনাবল। চোখের পলকে হাতে বেরিয়ে এসেছে ক্ষুর। ভয়ংকর ভঙ্গিতে হাতের তালুতে ঘষতে শুরু করল ঝকঝকে ক্ষুরের ফলা।
সরাও ওটা, ধমক দিল ঘোলাটে চোখো। অহেতুক খুন-জখমের কোন মানে নেই। ওদেরকে ছেড়ে দিলেই কি? ক্ষতি তো আর করতে পারছে না।
যদি প্লেনটা নিয়ে পালায়? বলল ইমেট চাব। ছেলেগুলো খুব বেশি চালাক। প্লেন চালাতে জানে কিনা কে জানে। এখুনি ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না।
আমারও তাই মনে হচ্ছে, বলল হ্যামার। তা ছাড়া আমরা যা খুঁজছি, ওগুলোর ব্যাপারেও হয়তো জানে।
নিশ্চয়ই, জোরে মাথা ঝাঁকাল চাব। বেঁধে ফেলে রাখি। সকালে শুনব আমরা কি কি জানে। সারা রাত বাঁধা থাকলে সকালে মন বদলাবে। গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করবে হয়তো। তাড়াহুড়ো করে এখনি কিছু করে ফেলার কি দরকার?
ঠিকই বলেছ, সায় দিল হ্যামার। বাধো, বেঁধে ফেলো। ইচ্ছে করলে যখন। খুশি মেরে ফেলে দিতে পারি, কিংবা ছেড়ে দিতে পারি। সেটা পরে ভাবব। ম্যাবরি, দড়ি আনো।
এক ধারে পড়ে থাকা মালপত্র ঘেঁটে দড়ি বের করল ম্যাবরি। খপ করে মুসার কব্জি চেপে ধরল। চাপের চোটে মুঠো আপনা-আপনি আলগা হয়ে গেল গোয়েন্দা সহকারীর, মোহরটা হাতেই ছিল, আঙুল খুলে যেতেই বালিতে পড়ল।
আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল ম্যাবরি, ছো মেরে তুলে নিল মোহরটা। কোথায় পেয়েছ? জিজ্ঞেস করল মুসাকে, দেখাচ্ছে সঙ্গীদেরকে।
জবাব দিল না মুসা।
কোথায় পেয়েছ? গর্জে উঠল হ্যামার। বলছ না কেন?
এটা সেই ডাবলুনটাই, ঠাণ্ডা গলায় বলল মুসা, লস অ্যাঞ্জেলেসে যেটা পেয়েছি।
মিছে কথা। ওটা অ্যালেন কিনির কাছে, বলল ম্যাবরি। বস, ওরা জানে মোহরের সন্ধান।
বললাম না, এটা সেই মোহরটাই, জোর গলায় প্রতিবাদ করল মুসা। অ্যালেন কিনির কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছি। আমাদের দেখে কিছু বুঝতে পারছ না? প্লেন ভেঙে মরার দশা, আর এনারা বলছেন মোহর খুঁজে পেয়েছি। আমাদের চেহারা দেখে সেরকম লাগছে?
দেখি তো মোহরটা, ম্যাবরির দিকে হাত বাড়াল হ্যামার।
দ্বিধা করছে ম্যাবরি।
কিশোরের মনে হলো, ঠিক ওভাবেই দ্বিধা করেছিল ববের বাবা, হয়তো ঠিক ওই জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে। হয়তো ওভাবেই হাত বাড়িয়েছিল হ্যামার সেদিনও। দিতে অস্বীকার করেছিল মিস্টার কলিনস।
আমি এটা রাখি, বস, অনুনয় করল ম্যাবরি।
কী ভাবল হ্যামার।
ঠিক আছে, রাখো। একটা নিয়ে গোলমাল করে লাভ নেই, অনেক পাব শিগগিরই।
খুশিতে বাগবাগ হয়ে মোহরটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল ম্যাবরি। তারপর দড়ি নিয়ে কাজে লেগে গেল। মুসার দুই কব্জি এক করে বাঁধল, ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে দুই পা বাঁধল। নরম বালি না হলে খুব ব্যথা পেত মুসা। ঠিক একই ভাবে কিশোরকেও বাধা হলো।
রাত রামল। চাঁদ উঠল। রূপালী আলোর বন্যায় প্লাবিত করে দিল চারপাশে, ছোট্ট ল্যাগুনের পানিকে মনে হচ্ছে এখন তরল রূপা।
বালিতে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল ইমেট চাব। অন্য তিনজনও তাই করল।
কিশোর আর মুসাকে শাসাল হ্যামার। সকালে তোমাদের ব্যবস্থা করব। দাঁড়াও! বলে শুয়ে পড়ল পাশ ফিরে।
দুই
পানি থেকে জ্যাকেটটা যখন তুলেছে মুসা, তখন সে কিংবা কিশোর তাদের বায়ে ভালমত তাকালেই দেখতে পেত ববকে। ঝড়ের তোড়ে সাগরের তল থেকে ছিঁড়ে উঠে আসা শেওলা স্তূপ হয়ে আছে একটা জায়গায়। ভেজা, পিচ্ছিল শেওলার স্তূপের তলায় প্রায় অর্ধেকটা ঢাকা পড়ে আছে ববের শরীর। না, মরেনি বব, খুব সৌভাগ্য, বিশাল একটা ঢেউ ছুঁড়ে ফেলেছে তাকে সৈকতে। বেহুঁশ হয়ে আছে।
মুসা আর কিশোর চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ নড়ল না বব। লাশ হয়ে পড়ে আছে যেন। সূর্য ডুবল। ভাটা শুরু হলো সাগরে! চাঁদ উঠল, ববের ফ্যাকাসে চেহারা আরও ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে এখন রূপালী জ্যোৎস্নায়। গর্ত থেকে বেরিয়ে মার্চ করে এগিয়ে এল একটা কাকড়া, দাঁড়া দুটো শূন্যে তুলে রেখেছে অদ্ভুত দুটো অ্যান্টেনার মত, চলার তালে-তালে দুলছে। দাঁড়ার মাথার ধারাল আঁকশি জোড়া মৃদু কিটকিট শব্দ করে একবার খুলছে, একবার বন্ধ করছে।
দুই গজ মত এগিয়ে হঠাৎ থেমে পড়ল কাঁকড়াটা, কোনরকম বিপদ আছে। কিনা আন্দাজ করতে চাইছে হয়তো। আরেক গর্ত থেকে আরেকটা কাঁকড়া এসে যোগ দিল প্রথমটার সাথে। আরেকটা, তারপর আরও একটা, দেখতে-দেখতে যেন। কাঁকড়ার হাট জমে গেল ওখানে। একটা অর্ধচন্দ্র সৃষ্টি করে একসঙ্গে মার্চ করে এগোল দলটা অবশ হয়ে পড়ে থাকা দেহটার দিকে। নীরব রাত ভরে গেল জীবগুলোর দাঁড়ার অদ্ভুত কিটকিট শব্দে। যতই এগোচ্ছে, ধীরে ধীরে গতি কমাচ্ছে কাঁকড়াগুলো, আশ্চর্য শৃঙ্খলা। সব কটার গতি একই রকম থাকছে, এতটুকু এদিক ওদিক নেই।
নড়েচড়ে উঠল ববের শরীর। চোখের পলকে থেমে গেল কাকড়া বাহিনী, একই সঙ্গে, তারপর দ্রুত একটা ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে পড়ল তিন দিকে। দেখতে দেখতে গায়েব হয়ে গেল।
চোখ মেলল বব। শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল তারাখচিত আকাশের দিকে, হঠাৎ করেই ফিরে এল বোধশক্তি, ডান কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল তাড়াতাড়ি। তাকাল জ্যোৎস্না-উজ্জ্বল সাগরের দিকে। পুরো এক মিনিট লাগল নিজেকে বোঝাতে যে, সে স্বপ্ন দেখছে না, সমস্ত ব্যাপারটাই কঠোর বাস্তব। উঠে দাঁড়াল সে। পাক দিয়ে উঠল মাথার ভেতর, গল গল করে বমি করে ফেলল। পেট থেকে নোনা পানি বেরিয়ে যাওয়ায় বরং ভালই হলো, হালকা হয়ে গেল শরীর আর মাথার ভেতরটা, টলোমলো পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে এখন। শরীরের জায়গায় জায়গায় ব্যথা অনুভব করছে, আঙুল কাঁপছে।