অবশেষে মনস্থির করে নিল সে, যাবে। পাহারা ছেড়ে যাচ্ছে বলে একটা অন্যায়বোধ পীড়া দিচ্ছে মনকে, জোর করে দমন করল সেটা। দ্রুত ছাত থেকে নেমে ঘরে ঢুকল। সবাই গভীর ঘুমে অচেতন। শান্ত পরিবেশ। পা টিপে টিপে একধারের দেয়ালের কাছে এসে ঠেস দিয়ে রাখল রাইফেলটা, হাতড়ে বের করল তার পিস্তল; কোমরে গুঁজে বেরিয়ে এল চত্বরে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে নৌকা খুলে সাগরে ভাসাল। রওনা হলো দ্বীপের দিকে।
বিকেলে যেখান দিয়ে উঠেছিল, সেখান দিয়েই উঠল বব। পাথরের খাঁজে নৌকা রেখে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। ওপরে উঠে নিচে তাকিয়ে দেখল একবার। নির্জন, কোন সাড়াশব্দ নেই। কেন জানি মনে হলো তার, এমনি নীরবতা বিরাজ করছিল তখন গ্যালিয়নের ভেতর, লুই ডেকেইনির কঙ্কালটা দেখার পর। তার প্রেতাত্মা ঘোরাফেরা করছে না তো? দূর, কি যা-তা ভাবছে? নিজেকে ধমক দিল। সে। কিন্তু ভয় তাড়াতে পারল না মন থেকে। আবার তাকাল এদিক ওদিক। অস্বস্তি বোধ করছে। আবার বোঝাল মনকে, মানুষ মরে গেলে আর কিছু করতে পারে না। ভূত-ফুত সব বাজে কথা। গর্তটার কাছে এসে দাঁড়াল সে, ম্যাবরির ভয়ে যেটাতে লুকিয়েছিল, মোহরটা যেটাতে ফেলেছে ওমর, সেই গর্ত। আবার ফিরে তাকাল। চাঁদের আলোয় রহস্যময় মনে হচ্ছে বনভূমিকে, কিছু কিছু ছায়াকে মানুষের ছায়া বলে ভুল হচ্ছে। হ্যামার আর ইমেট চাব লুকিয়ে থেকে তাকে দেখছে না তো?
ভীষণ দুরুদুরু করছে বুক। গর্তে নেমে পড়ল বব। আশ্চর্য, মাটিতে হাত দিতেই পেয়ে গেল মোহরটা। হাতে নিয়েই মনে পড়ল ওটার অশুভ ক্ষমতার কথা। কাঁপা হাতে মোহরটা নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। গর্তের বাইরে চ্যাপ্টা একটা পাথরে মোহরটা রেখে দুহাতে ভর দিয়ে গর্ত থেকে বেরোতে গেল। কিন্তু গর্তের দেয়ালে বেরিয়ে থাকা একটা পাথরে আটকে গেল পিস্তল, হ্যাঁচকা টানে আবার নেমে আসতে বাধ্য হলো বব। বেল্ট থেকে খুলে গর্তে পড়ে গেল পিস্তল। যতই তাড়াহুড়ো করতে চায় আরও দেরি হয়ে যায়। বসে পড়ে পিস্তলটা হাতড়ে খুঁজতে শুরু করল।
হাতে ঠেকল গোল একটা কিছু, পিস্তল নয়। জিনিসটার আকার আর ওজন চমকে দিল তাকে। কিন্তু ডাবলুনটা তো রেখে দিয়েছে বাইরে, পাথরের ওপর। তাহলে এটা কি আরেকটা? উঠে মুখ বাড়িয়ে দেখল, ডাবলুনটা আগের জায়গায়ই আছে। কিন্তু হাতেও তো আরেকটা। চাঁদের আলোয় চমকাচ্ছে, ভুল হতেই পারে। না। তারমানে দুটো হলো? অসম্ভব…বিশ্বাস করতে পারছে না সে। উত্তেজনায় কাঁপছে, কপাল বেয়ে দরদর করে ঝরছে ঘাম। ভূতের ভয় ফিরে এল আবার মনে। নিশ্চয়ই ডেকেইনির ভূতই এক কাণ্ড করছে, তাকে বোকা বানানোর জন্যে। কেন যে এসেছিল মরতে? কেন এসেছিল অভিশপ্ত মোহরের লোভে…
আরেকটা ভাবনা মাথায় আসতেই চকিতে দূর হয়ে গেল ভূতের ভয়। ঝট করে বসে পড়ে আঙুল দিয়ে খামচে মাটি সরাতে শুরু করল। এক গাদা গোল জিনিস হাতে ঠেকল, গলা শুকিয়ে গেল তার। বেড়ে গেল বুকের দুরুদুরু । দম বন্ধ হয়ে যাবে যেন। গর্তের দেয়ালে হেলান না দিয়ে আর পারল না, এক মুঠো গোল জিনিস তুলে নিয়ে দেখল। শব্দ শুনল। না, কোন ভুল নেই। মোহরই। পেয়েছে। পেয়ে গেছে সে ডেকেইনির গুপ্তধন! মোহর! মোহর! চেঁচিয়ে উঠল সে নিজের অজান্তেই। ভুলে গেল পিস্তলের কথা, ভুলে গেল কোথায় রয়েছে। বসে পড়ে আবার মাটি খুঁড়তে শুরু করল আঙুল দিয়ে। আরও মোহর ঠেকল হাতে। হাতে জোরে কামড় মারল সে। জেগেই আছে, ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে না।
জামা পাজামায় পকেট নেই, মোহর নিয়ে যেতে পারবে না, যেখানে ছিল সেখানেই ওগুলো আবার ফেলে বেরোতে যাবে, এই সময় কানে এল মানুষের কথা। ধড়াস করে এত জোরে লাফ মারল হৃৎপিণ্ড, ববের মনে হলো বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার চিনতে পারছে কণ্ঠস্বর। হ্যামার।
এদিকেই কোথাও লুকিয়েছে ব্যাটারা, তখনও বলেছি, এখনও বলছি, তিক্ত শোনাল হ্যামারের কণ্ঠ।
তো হলো কি তাতে? ইমেট চাব বলল। ঘাবড়ানোর কি আছে? কাল বেড় দিয়ে ধরব ব্যাটাদের!
ওরা কি করছে যদি জানতে পারতাম, বলল হ্যামার। পরক্ষণেই স্বর বদলে গেল। আরে, ওটা কি?
দ্রুত এগিয়ে এল দুই জোড়া পায়ের শব্দ, শুনতে পেল বব। গর্তের পারে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে।
আরে, মোহর, ইমেট চাবের বিস্মিত কণ্ঠ, এটা এল কোথা থেকে?
নিশ্চয়ই মোহরগুলো খুঁজে পেয়েছে ব্যাটারা। নেয়ার সময় পড়ে গেছে কোনভাবে।
না, ম্যাবরির পকেট থেকে পড়েছে। ওর কাছে একটা মোহর ছিল, মনে আছে? এখানেই পড়েছিল সে, এখান থেকেই তুলে নিয়ে গেছি। ওই যে, রক্ত। মোহরটা রাখতে পারল না বেচারা। আর দেখেই বা কি হবে? যেখানে গেছে, ওখানে মোহর কোন কাজে লাগবে না।
হাত সরাও, ইমেট, আমি আগে দেখেছি, ওটা আমার, কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল হ্যামার।
কি হলো, বিগ? এটা কি ধরনের ব্যবহার? একটা মোহরই তো, এটার জন্যে …
দাও বলছি ওটা! হ্যামারের গর্জনে গর্তে থেকেও কেঁপে উঠল বব।
নইলে কি করবে? পাল্টা গর্জন করে উঠল ইমেট চাব। ও ছুরি…ছুরির ভয়। দেখাচ্ছ… কথা বন্ধ হয়ে গেল তার আচমকা, বিচ্ছিরি ঘড়ঘড়ানি শোনা গেল। ধড়াস করে মাটিতে আছড়ে পড়ল ভারি কিছু, পাথরে ঘষাঘষির শব্দ হলো কয়েক মুহূর্ত, তারপর চুপ।