মাপ চাই, ভাই, আমি পারব না, হাতজোড় করল মুসা।
আরে দূর, এসো, হাত ধরে টানল কিশোর, কঙ্কালই তো, ভয় কি? পাথরের যেমন প্রাণ নেই, ওগুলোরও নেই।
কিন্তু কঙ্কাল দুটো বের করে ফেলার সময় দেখা গেল, মুসার চেয়ে কম ভয় পাচ্ছে না কিশোর, কম অস্বস্তি বোধ করছে না। হেঁইও হেইও করে কঙ্কাল দুটো পানিতে ফেলে দিল ওরা।
বব, তুমি থাকো, বলল ওমর। দুঘণ্টা পর এসে মুসাকে ডেকে দিয়ো।
কিন্তু সময় বুঝব কি করে? প্রশ্ন তুলল বব। ঘড়ি কই?
অনুমান, কিশোর বলল।
ওই যে, ওদিকে নারকেল গাছগুলো দেখেছ? চাঁদ যখন গাছগুলোর মাথায় উঠবে, ধরে নেবে, দুঘণ্টা হয়েছে। ও হ্যাঁ, বন্দুক রেখো সঙ্গে।
আই, আই, মিস্টার ট্রেলনী, স্যার, ট্রেজার আইল্যাণ্ডের জিম হকিনসের সংলাপ ধার নিল বব। পাহারা দিতে চলল।
সাত
সময় যেন কাটতেই চাইছে না ববের। অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিচ থেকে কথাবার্তা শোনা গেল, কমতে কমতে থেমে গেল এক সময়। নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। গ্রীষ্মমণ্ডলের রাত, কেমন যেন শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ, অসহ্য নীরবতা। সামান্যতম শব্দ নেই কোথাও। পাথরে ঢেউ আছড়ে পড়ার মৃদু ছপছপ শব্দ ছিল, সেটাও থেমে গেছে। নারকেলের পাতা স্থির, তারাগুলো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, এত কাছে মনে হচ্ছে, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। আকাশ যেন মস্ত এক গম্বুজ, ওখান থেকে সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে কেউ তারাগুলো। দিগন্তে উঁকি দিল লালচে চাঁদ, ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করল ওপরে, রূপালী করে দিল সাগরকে। রহস্যময় হয়ে উঠল দ্বীপটা। সাদা। বালির সৈকত আর মাঝে মাঝে পাথরের স্তূপকে দেখে মনে হচ্ছে, সাগরের পানি থেকে মাথা তুলেছে কোন অজানা দানব।
অবাক হয়ে প্রকৃতির এই রূপ দেখছে আর ভাবছে বব। পাশে রাখা বন্দুকের গায়ে হাত বোলাল। ঠিক এখানটায় এমনিভাবে বন্দুক নিয়ে বসে দূর অতীতে এমনি কোন রাতে নিশ্চয়ই পাহারায় ছিল কোন জলদস্যু। যে দুটো কঙ্কাল ফেলে দিয়ে এসেছে খানিক আগে, তাদেরও কেউ হতে পারে। আচ্ছা, ওদেরই মত ববও তো একদিন কঙ্কালে পরিণত হবে, সেদিনও কি ঠিক এমনি থাকবে প্রকৃতি? এমনি করে চাঁদ উঠবে, জ্যোৎস্না বিলাবে, আকাশে জ্বলবে তারা? এমনিই থাকবে সব, জানে বব, কিন্তু বিশ্বাস করতে মন চায় না। এই সুন্দর পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে সে একদিন, মানুষের মন থেকে চিরতরে মুছে যাবে তার স্মৃতি, ভাবতেই যেন কেমন লাগে। কোন দিন মনে হয়নি, কিন্তু এই পরিবেশে আজ হঠাৎ করেই মনে হলো, জীবনের কোন অর্থ নেই। এই জন্মানো, বেঁচে থাকা, তারপর একদিন মরে যাওয়া, এর কোন মানেই নেই।
আচ্ছা, এই দুর্গে কারা ছিল? ডেকেইনির লোক? নাকি দিগ্বিজয়ী মহানাবিক ড্রেক? জানে না বব, হয়তো কেউই জানে না, জানার কোন উপায় নেই। আহা, কি রোমাঞ্চকর দিনই না কাটিয়েছে তারা! মরে গেছে ঠিক, কিন্তু উপভোগ করে গেছে জীবনটা। আফসোস হলো ববের, কেন আরও দুতিনশো বছর আগে জন্মাল না? ড্রেকের নাবিকদলের একজন হতে বড় ইচ্ছে করে। লুই ডেকেইনির দলের কেউ হতেও আপত্তি থাকত না তার। সেই তো জন্মাল, কিন্তু এমন এক যুগে, যখন ভাত কাপড়ের চিন্তা করতেই সময় শেষ। দুত্তোর, জন্মানোর নিকুচি করি, লাথি মারি এই বেঁচে থাকার কপালে!-বিড়বিড় করল সে। ভাগ্যিস কিশোর পাশার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, নইলে এই কদিনের অভিযানের স্বাদটুকুও পাওয়া হত না।
প্রচণ্ড হতাশা গ্রাস করল, তাকে। কপালগুণে মোহর যদি পায়, বড়লোক হয়তো হবে, খাওয়া-পরার ভাবনা হয়তো থাকবে না, কিন্তু লুই ডেকেইনির মত জলদস্যু কি আর হতে পারবে? পাবে সেই রোমাঞ্চের স্বাদ? হতে পারবে ড্রেকের মত দিগ্বিজয়ী নাবিক? পাবে না, কোনদিনই পারবে না, কারণ সেই যুগ আর নেই। চিরতরে শেষ হয়ে গেছে। কাঠের জাহাজে পাল তুলে অজানার উদ্দেশে বেরোনোর অবকাশ আর নেই। ববের ধারণা, মানুষ নিজেই নিজের সর্বনাশ করেছে ইঞ্জিন আবিষ্কার করে, লোহা আর ইস্পাত দিয়ে জাহাজ তৈরি করতে শিখে। মস্ত চিমনি দিয়ে ভকভক করে বেরোয় কালো ধোয়া, দূর, এ কোন দৃশ্য হলো নাকি? সাদা পাল ঘিরে চক্কর দেয়া উড়ন্ত সী-গাল, সফেদ অ্যালট্রেস, কোথায় সেই ছবি, আর কোথায় কালো…মাঝে মাঝে গেঁউউউউ করে কান ঝালাপালা করে দিয়ে বেজে ওঠা লোহার জাহাজের বিরক্তিকর বাঁশি…বাতাসে থাবা দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ সরানোর চেষ্টা করল। যেন বব।
কিন্তু এই মুহূর্তে জীবন খুব একটা একঘেয়ে নয় ববের জন্যে, অনেকের চেয়ে সে ভাগ্যবান। দারুণ রোমাঞ্চকর এক অভিযানে এসেছে। আর সত্যিই যদি গুপ্তধন পেয়ে যায় তাহলে তো এক লাফে বড়লোক। গুপ্তধন, মোহর!-শব্দ দুটো উচ্চারণ করল সে বিড়বিড় করে। কোথায় আছে ওগুলো? ম্যাপটার কথা ভাবল। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি। আচ্ছা, মোহরটায় কোন সঙ্কেত নেই তো? যেটা গর্তে ফেলে দিয়েছে ওমর ভাই? যেটাকে অভিশপ্ত ভাবা হচ্ছে।
যতই ভাবল বব, মনে হলো, উচিত হয়নি, মোটেই উচিত হয়নি ফেলে দেয়া। ভালমত দেখা দরকার ছিল। হয়তো ওতেই রয়েছে গুপ্তধনের নিশানা, আঁচড় কেটে বা অন্য কোনভাবে চিহ্ন দিয়ে রেখেছে হয়তো ডেকেইনি।
মোহরটা পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠল ববের। খুব বেশি দূরে তো নয়। নৌকা নিয়ে যাবে আর আসবে, বড় জোর মিনিট দশেক লাগবে। এটুকু সময়ে কিছু ঘটবে না, নিজেকে বোঝাল বব। পাহারা ছেড়ে যাওয়া মোটেই উচিত হবে, এটাও জানে। কিন্তু সব কিছুই এত বেশি শান্ত, অঘটন ঘটার আশঙ্কা মনে আসতেই চাইছে না।