ভাগ্যের কি পরিহাস, বিড়বিড় করল ওমর। যে কঙ্কালের চিহ্ন উড়িয়ে হাজার হাজার মানুষকে খুন করেছে সে, সেই কঙ্কাল হয়ে নিজেই বসে আছে এখন। চেয়ারে; তার কঙ্কালখচিত পতাকার কাছেই। মুহূর্তের জন্যেও এখন এই দৃশ্যটা যদি দেখতে পেত ডেকেইনি।
পতাকাটা আবার ভাজ করে ববের দিকে ছুঁড়ে দিল কিশোর। রেখে দাও, চমৎকার ট্রফি। তুমি রাখতে না চাইলে পরে আমাকে দিয়ে দিয়ো।
আরেক ড্রয়ারে পাওয়া গেল খুব সুন্দর একটা চুনি বসানো আঙটি।
দেখি তো, হাত বাড়াল ওমর। আঙটিটা নিয়ে দেখতে লাগল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।
অন্য আরেক ড্রয়ারে পাওয়া গেল শখানেক রূপার মুদ্রা। একটা তুলে নিয়ে দেখে বলল কিশোর, পিসেস অভ এইট। মুসা, একটা ব্যাগ-ট্যাগ পাও নাকি দেখো তো। নিয়েই যাই এগুলো। হ্যামারের হাতে পড়লে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। আমরা যেমন দেখেছি, ওরাও দেখে ফেলতে পারে জাহাজটা।
এরপর সবাই মিলে খুঁজল পুরো ঘর। প্রতিটি আলমারি খুঁজে দেখল। মোহর মিলল না কোথাও। রয়েছে গাদা গাদা সিল্ক, সাটিন আর মিহি সুতার কাপড়, পোকায় কেটে নষ্ট করে দিয়েছে। জাহাজের খোলে ঢুকে, খোঁজাখুঁজি করল। মোহর পাওয়া গেল না, তবে কয়েক পিপা ছাতা পড়া চিনি, কফি আর ময়দা পেল।
অনেক জায়গা খোঁজার বাকি রয়ে গেল, থাকারও ইচ্ছে আছে ওদের। কিন্তু থেকে লাভ নেই। অন্ধকার হয়ে গেছে।
আলো ছাড়া হবে না, বলল ওমর।
আলো থাকলেও রাতে থাকছি না আমি এখানে, জোরে মাথা নাড়ল মুসা। লুই ডেকেইনির ভূত ঠিক এসে ঘাড় মটকাবে।
মুসার বলার ধরনে হেসে ফেলল সবাই।
এই, ওমর ভাই, আবার বলল মুসা, খিদে পায়নি আপনার? চলুন না, বেরোই।
হ্যাঁ, চলো যাই। সকালে আবার আসব।
কিন্তু যত সহজে বলে ফেলল, তত সহজে বেরোনো গেল না। উঠবে কিভাবে? ওমরের কাঁধে দাঁড়িয়ে ফোকরের ধার ধরে দোলা দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল মুসা, তক্তা ভেঙে ধুড়ম করে পড়ল আবার নিচে, সবার ভয় হলো, স্যালুনের মেঝে ভেঙে না। খোলে পড়ে যায়। ওভাবে বেরোনোর চেষ্টা বাদ দিতে হলো। একা বেরোতে কতখানি কষ্ট হয়েছিল ববের বাবার, উপলব্ধি করল ওরা। মনে পড়ল, জাহাজের খোল কেটে বেরিয়েছিল কলিনস।
খোঁজাখুঁজি করতেই ফোকরটা পাওয়া গেল, জাহাজের সামনের গলুইয়ের নিচে। হাতে হাতে ট্রফিগুলো নিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। বিষণ্ণ অতীত ছেড়ে বেরিয়ে এল যেন বর্তমান পৃথিবীর উজ্জ্বল তারাখচিত আকাশের নিচে।
যেভাবে রেখে গিয়েছিল, তেমনিই রয়েছে নৌকাটা। পানিতে নামিয়ে তাতে চড়ে বসল সবাই। ফিরে এল উপদ্বীপে।
কাল খুব সকালে বেরোব, যেতে যেতে বলল ওমর। নারকেলের মালায় নারকেলের পানি, শক্ত শুকনো খাবার গলায় আটকে গেলে সেই পানি দিয়ে নামিয়ে নিচ্ছে। মোহর খোঁজার আগে এই দুৰ্গটাকে দুর্ভেদ্য করে নিতে হবে। প্রতিরোধ যাতে করতে পারি, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারব না। এখানে, এক সময় দেখে ফেলবেই হ্যামার আর ইমেট চাব, জেনে যাবে কোথায়। আছি আমরা। হয়তো বারডুও ফিরে আসবে। কি করবে তখন ব্যাটারা? আমি হলে, দ্বীপের প্রান্তে এসে পাথরের স্তূপের আড়ালে বসে থাকতাম, যাতে উপদ্বীপ থেকে কেউ বেরোতে না পারে। ওরাও যদি তাই করে? আমি হলে অবশ্য দেখামাত্র গুলি করতাম না, কিন্তু ওরা করবে।
কি করব আমরা কাল সকালে, বললেন না? শুকনো মাংস চিবাতে চিবাতে বলল মুসা।
প্রচুর নারকেল এনে জমিয়ে ফেলতে হবে। বারুদ আনতে হবে জাহাজ থেকে, লড়াই লেগে গেলে তখন অনেক বারুদের দরকার পড়বে। আর আজ রাত থেকেই পাহারা দিতে হবে আমাদের।
খাওয়া শেষ হলো। প্রথমে ববকে পাহারায় রাখার সিদ্ধান্ত নিল ওরা। দুঘণ্টা পর এসে মুসাকে তুলে দেবে সে। এমনি করে একজনের পর একজন পাহারা দিয়ে রাতটা পার করে দেবে।
ম্যাপটা ভালমত দেখা দরকার, বলল কিশোর।
এখনই? বলল ওমর। সকালে দেখলে হয় না? খামোকা মোম জ্বালিয়ে লাভ কি?
ভাগ্য ভাল, আমাদের জিনিস আবার ছিনিয়ে আনতে পেরেছি হ্যামারের কাছ থেকে। কিন্তু তা না হলেও কি অন্ধকারে থাকতাম? এত নারকেল থাকতে? হাসল। কিশোর।
আলোর অভাব হবে না। পকেট থেকে ম্যাপটা বের করে আলোর সামনে বিছাল সে। জাহাজ থেকে পালকের কলম, কালির দোয়াত নিয়ে এসেছে। কালি শুকিয়ে গেছে, কিন্তু তাতে সামান্য পানি ঢেলে নিতেই আবার কালি হয়ে গেল। পাতলা কালি, তবে কাজ চলবে।
আরেকটা ম্যাপ এঁকে ফেলি, বলল কিশোর। ডেকেইনির লগবুক থেকে একটা শাদা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তাতে আরেকটা ম্যাপ আঁকল। ডেকেইনির আঁকা ম্যাপটার মতই হলো অবিকল, নকলটার মত ভুল জায়গায় চিহ্ন দিল না, যতদূর সম্ভব সঠিক জায়গায় দেয়ার চেষ্টা করল। সবই আঁকল ঠিকঠাক, কিন্তু কোনটা কিসের চিহ্ন জানে না। এক দুর্বোধ্য রহস্য মনে হলো। অন্য তিনজনের দিকে চেয়ে বলল, কিছু বোঝা যাচ্ছে?
তুমি বুঝেছ? মুসা প্রশ্ন করল।
না।
কিশোর পাশা যে রহস্যের মীমাংসা করতে পারেনি, আমরা তার কি কচুটা বুঝব? আমি ঘুমাতে যাচ্ছি, তুমি সমাধান করে জানিও, উঠল মুসা, কম্বল বিছাবে।
আরে দাঁড়াও, কাজ আছে, হাত তুলল কিশোর।
কি? ঘুরে তাকাল মুসা।
ওই দুই ভদ্রলোক, ঘরের কোণ দেখাল কিশোর। ওদেরকে ঘরে রেখে ঘুমাতে অস্বস্তি লাগবে। চলো, সাগরে ফেলে দিয়ে আসি।