চেহারার ভাব বদলে যাচ্ছে ওমরের, দৃষ্টি বদলে যাচ্ছে, বইয়েব দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে মাথা। বড় বড় হয়ে গেছে চোখ, হাতের আঙুল কাঁপছে। মুখ তুলে তাকাল। সে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কি আছে, এতে জানো? খসখসে হয়ে গেছে ওমরের কণ্ঠ। ভয়ঙ্কর এক খুনীর কথা, এই একটু আগে যার কথা বলেছিলাম। লুই ডেকেইনি, যার অনেকগুলো নাম, লুই লা গ্রানডি, দি এস্টারমিনেটর, নিজেকেই একস্টারমিনেট করেছে, আত্মহত্যাই করেছে বোধহয়।
হঠাৎ করেই বড় বেশি নীরব হয়ে গেল ঘরটা। ঠিক এমনি নীরবতা বিরাজ করেছিল তিনশো বছর আগে, ডেকেইনি গুলি খাওয়ার আগের মুহূর্তে।
লম্বা দম নিল ওমর। হাতের বইটা দেখিয়ে বলল, এটা ডেকেইনির লগবুক। দারুণ লাগবে পড়তে। নিশ্চয়ই লেখা আছে, কিভাবে, কখন কোন্ খুনটা করেছিল, কি কি করেছিল। ভাবছি, কত বীরত্বের গাথা লেখা আছে এতে? কত নিরীহ নাবিকের মৃত্যুর কাহিনী? দেখি তো, ডেকেইনি কিভাবে মারা গেছে… দ্রুত পাতা উল্টে চলল সে। লেখা যে পৃষ্ঠায় শেষ, সেটাতে এসে থামল। পড়তে শুরু করল জোরে জোরে:
…রাম শেষ, জাহাজে বিদ্রোহ চলছে, সবাই দ্বিধাগ্রস্ত। বউনের মোহরই এজন্যে দায়ী, নরকে পচে মরুক চোর হারামজাদা। বার বার এসে আমাকে চাপ দিচ্ছে নাবিকেরা, সমস্ত মোহর সাগরে ফেলে দিতে বলছে, কিন্তু আমি কি আর রাজি হই? মোহরটা অভিশপ্ত হলে ওরাও মরবে, মরুক আগে, আমি দেখি, তারপর যা করার করব।
বাতাস বাড়ছে আবার, পাল তোলার কেউ নেই। পাইকারী খুন, বিদ্রোহ, ঝড়, নীরবতা, পানির সমস্যা, তারপর আবার ঝড়ের সঙ্কেত। মনে হচ্ছে, শয়তান নিজে এসে হাত লাগিয়েছে, জাহাজে বাস করছে যেন সে, সবাইকে, সব কিছুকে ধ্বংস না করে ছাড়বে না। হারামজাদা বউন, নিজেও মরেছে, পোর্ট রয়ালের ফাঁসিকাঠে নিশ্চয়ই শেকলবাধা অবস্থায় পচে-গলে শেষ হচ্ছে এখন, আমাদেরকেও মেরে রেখে গেছে। ওর মোহরে ভর করেই যেন এসেছে শয়তান। সবাইকে শেষ করেছে, কেউ পাগল হয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, হাঙরেরা খতম করেছে তাদের, কেউ ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, বাকি রয়েছি আমি…
চুপ হয়ে গেল ওমর।
আর কিছু নেই? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না।
ডেকেইনি এরপর কি করল, খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
জানা যাবে না কোনদিনই। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ? বার বার বউনের মোহরের কথা উল্লেখ করেছে। বউনের অভিশপ্ত মোহর। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ডেকেইনির নাবিকেরা। বউন কে জানি না, আমেরিকায় ফিরে জ্যামাইকার পুরানো রেকর্ড ঘাটাঘাটি করলে হয়তো জানতে পারব। আমার ধারণা, বউনের মোহরই পড়ে ছিল এই টেবিলে…।
বাবা যেটা তুলে নিয়েছিল, বলে উঠল বব।
হ্যাঁ। কুসংস্কার নেই আমার, আগেই বলেছি। কিন্তু তবু কিছুতেই অবিশ্বাস করতে পারছি না, মোহরটার কিছু অশুভ ক্ষমতা আছে। যেখানে যার হাতেই গেছে, তারই ক্ষতি করেছে। যতক্ষণ আমাদের কাছে ছিল, একটা পর একটা বিপদে পড়েছি। ওটা হাতছাড়া হওয়ার পর থেকেই ভাগ্য ভাল হতে শুরু করেছে। অ্যালেন কিনি নিয়েছিল ওটা, তার অবস্থা দেখেছি আমরা। তারপর আমাদের কি দুরবস্থা। ববের কপাল ভাল, জ্যাকেটটা খুলে ফেলেছিল, নইলে সে-ও মরত। আশ্চর্য, জ্যাকেটটা এত ঝড়েও ভেসে গেল না, তীরে এসে পড়ল। কিশোর আর মুসা, তোমরা পেলে ওটা, মোহরটা নেয়ার একটু পরেই কি বিপদে পড়েছ, মরতে মরতে বেঁচ্ছে। ম্যাবরি নিল ওটা, গুলি খেলো আমার হাতে। আমার বিশ্বাস, ওই মোহরের জন্যেই শেষ হয়ে গেছে ডেকেইনি আর তার দলবল।
আরও অনেক মোহরের উল্লেখ করেছে ডেকেইনি, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর।
বলেছে, বলল ওমর, কিন্তু কেন বলেছে? কেন সব মোহর সাগরে ফেলে দিতে চাপ দিয়েছে নাবিকেরা? কারণ, তারা জানত, ওই মোহরের সঙ্গে বউনের মোহরটাও আছে। জানত না, ঠিক কোটা বউনের অভিশপ্ত মোহর। তাই জাহাজে যত মোহর ছিল, সব ফেলে দিতে চেয়েছে।
শেষ অবধি কি তাহলে সব মোহর ফেলে দিয়েছিল? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর। নইলে গেল কোথায় ওগুলো?
আমার মনে হয় ফেলেনি, ওমর বলল। তাহলে বউনের মোহরটা থাকত না ডেকেইনির কাছে, সে নিজেও মরত না। মোহরগুলো আছে হয়তো জাহাজে, কিংবা কাছাকাছি কোথাও।
কিন্তু কোথায় আছে? ভুরু নাচাল মুসা।
সেটা বের করার জন্যেই তো এসেছি আমরা, বলল কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করেছে সে। আমার মনে হয় মোহর লুকিয়ে রেখে জায়গাটার ম্যাপ তৈরি করে ডেকেইনি, তারপরই কোনভাবে মারা যায়। তার আঁকা আসল ম্যাপটা নেই এখন আমার কাছে, তবে নকলটা আছে, আর কোন কোন জায়গা বদল করেছি, সেটাও মনে আছে আমার। দেখি রহস্য ভেদ করা যায় কিনা। পকেট থেকে নকল ম্যাপটা বের করল সে। একটা কলম দরকার, বলেই চোখ পড়ল। টেবিলের ওপর। এগিয়ে গিয়ে তুলে নিল পালকের কলমটা, যেটা দিয়ে লিখেছিল ডেকেইনি। ছাতের ফোকর দিয়ে বাইরে তাকাল, আলো কমে গেছে। বেরোনো দরকার। আর, পনেরো মিনিটেই অন্ধকার হয়ে যাবে। খুব কাছাকাছি না থাকলে আজ আর খুঁজে বের করা যাবে না মোহর, সময় নেই। তাড়াহুড়ো করে দেখে নিই একবার। কলম আর ম্যাপ টেবিলে রেখে দিয়ে কাজে লেগে গেল সে।
টেৱিলের বাকি ড্রয়ারগুলো খুলে দেখল কিশোর। বেশ কিছু জিনিস রয়েছে, তার মধ্যে তিনটে জিনিস মনোযোগ আকর্ষণ করল। তার একটা, কালো এক টুকরো কাপড়। সুন্দরভাবে ভাজ করা। মনে হলো টেবিলক্লথ। ড্রয়ারটা লাগিয়ে দিল কিশোর, হঠাৎ কি মনে পড়তেই টেনে আবার খুলল। কাপড়ের এক কোণ ধরে বের করে এনে ঝাঁকি দিয়ে খুলল পুরোটা, দুহাতে ধরে ছড়াল। কালো একটা পতাকা, মাঝখানে মানুষের খুলির তলায় মানুষের হাড়ের ক্রসচিহ্ন-সাদা কাপড় কেটে সেলাই করে লাগানো হয়েছে। একটা হাড়ের নিচে লেখা বড় হাতের এল, আরেকটার নিচে ডি।