সাবধানে, খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ওরা দেখতে দেখতে, যেন যাদুঘরে। রয়েছে, কোন কিছুতে পা পড়লে কিংবা হাত দিলে যেন এখুনি হাঁ-হাঁ করে ছুটে আসবে প্রহরী।
পাথরের এক বিশাল বয়েম দেখাল ওমর, বোতলের গলাটা খুব সরু, মুখে পাথরের ছিপি আঁটা। গায়ে কালো কালিতে ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে লেখা রয়েছে: বেস্ট ওল্ড জ্যামাইকা। বোতলটার দিকে চেয়ে, ট্রেজার আইল্যাণ্ডে জলদস্যুদের গাওয়া সেই বিখ্যাত চরণটি সুর করে গেয়ে উঠল ওমর, ইয়ো হো হো, অ্যাণ্ড আ বটল অভ রাম। ভারি পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করল সে।
নিশ্চয়ই ভেতরে রয়েছে অনেক পুরানো মদ। বোতলটার দিকে চেয়ে মাথা ঝোঁকাল কিশোর, হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে ওটা থেকে নিয়ে খেলে পরের চরণটাও সত্যি হয়ে যাবে: ড্রিংক অ্যাণ্ড ডেভিল হ্যাভ ডান ফর দ্য রেস্ট।
ওপরে ওঠার একটা সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামল ওরা। ভালমত পরীক্ষা করে দেখল, ভার সইতে পারবে কিনা, তারপর পা দিল ওতে। বড় একটা ঘরে এসে, ঢুকল। এটা ক্যাপ্টেনের স্যালুন।
ছাতের প্রায় গোল একটা ফোকর দিয়ে আলো আসছে। ঠিক নিচেই জমে রয়েছে শুকনো পাতা, কুটো, ছেঁড়া শুকনো লতা আর শেওলা। আঙুল তুলে ফোকরটা দেখিয়ে বলল কিশোর, ওখান দিয়েই পড়েছিলেন ববের বাবা।
ববের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
ইয়াল্লা! ফিসফিস করে বলল ওমর, দেখো, দেখো! মাথা নাড়ছে আস্তে আস্তে, বিশ্বাস করতে পারছে না যেন।
অন্যেরা দেখল, নাড়া খেলো ওমরের মতই।
প্রচুর টাকা খরচ করে সাজানো হয়েছিল স্যালুনটা। দেয়ালের জায়গায় জায়গায় লাগানো রয়েছে সোনালি রঙের সুদৃশ্য প্রদীপদানি, তার ফাঁকে ফাঁকে নানারকম ছবি, সবই সাধুদের কিংবা ধর্মীয় কোন পবিত্র দৃশ্যের। অপরূপ কার্পেটে ঢাকা পুরো মেঝে, আর কি তার রঙ। উজ্জ্বল লাল আর নীলের মাঝে সোনালি আলপনা। দেয়ালের সঙ্গে লোহার চ্যাপ্টা দণ্ড দিয়ে আটকানো রয়েছে বড় বড় আলমারি, ঢেউয়ের দোলায় বা ঝড়ের ঝাঁকুনিতে যাতে স্থানচ্যুত না হতে পারে, সে জন্যে। আলমারির আঙটায় ঝুলছে বড় বড় তালা, বেশির ভাগই খোলা। সামনের দিকের দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে ওয়ালনাট কাঠের মস্ত এক টেবিল, তাতে চমৎকার খোদাইয়ের কাজ। কিন্তু এসব দেখে নাড়া খায়নি দর্শকরা। তাদের চমকে দিয়েছে। একটা কঙ্কাল। উঁচু পিঠওয়ালা, জায়গায় জায়গায় তামার কাজ করা একটা ভারি চেয়ারে বসে টেবিলে ঝুঁকে পড়ে রয়েছে কঙ্কালটা।
খাইছে! ভয়ে ভয়ে বলল মুসা। জ্যান্ত মনে হচ্ছে! তার ভয়, এখুনি বুঝি, হ্যাল্লো, কেমন আছ, বলে হাত মেলাতে উঠে আসবে পোশাক পরা কঙ্কালটা।
আস্তে আস্তে কঙ্কালটার কাছে এগিয়ে গেল ওমর। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চেহারা। বিকট ভঙ্গিতে দাঁত খিঁচিয়ে আছে যেন কঙ্কাল, কালো অক্ষিকোটর আরও ভয়ংকর করে তুলেছে চেহারাকে, দীর্ঘ এক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে রইল ওমর, পরনের কাপড়-চোপড়গুলো দেখল।
ওমরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। ভালমত দেখে বলল, জাহাজটা স্প্যানিশ, সন্দেহ নেই, খুব আস্তেই বলেছে সে, কিন্তু অস্বাভাবিক এই নীরবতায় অনেক জোরালো হয়ে কথাটা কানে বাজল যেন, কিন্তু এই লোকটা স্প্যানিয়ার্ড ছিল না। পোশাক দেখেছেন? জলদস্যুর। নিশ্চয়ই কোন অঘটন ঘটেছিল, ওর দলে বোধহয় ও-ই বেঁচেছিল শেষ অবধি, বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে টেবিলে পড়ে থাকা পিস্তলটা তুলে নিল সে। উল্টে পাল্টে রেখে ওমরের হাতে দিয়ে বলল, দেখুন তো! পিস্তল-বন্দুকের ব্যাপারে আমি আনাড়ি।
ভালমত নাড়াচাড়া করে দেখল পিস্তলটা ওমর, গন্ধ শুকল। গুলি নেই ভেতরে। মনে হয়…মনে হচ্ছে, কাঁপা কাঁপা হাতে কঙ্কালটাকে চেয়ারসুদ্ধ সামান্য সরাল সে, ঘোরাল নিজের দিকে। দেখো, দেখো!
সবাই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এল, ওমর কি দেখেছে দেখার জন্যে। রঙচটা পোশাকের পেটের কাছটায় চেপে রয়েছে কঙ্কালের ডান হাতের আঙুলগুলো। গোল। একটা ছিদ্র শার্টে, ছিদ্রের ধারটা পোড়া।
এদিক ওদিক তাকাচ্ছে ওমর, মেঝেতে চোখ পড়তেই চমকে উঠল। খোদা! জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিল সে। এই পিস্তলের গুলিতেই মরেছে। আত্মহত্যা নয়তো? দেখো।
দেখল সবাই। কঙ্কালটার জুতোর চারপাশ ঘিরে কার্পেটে কালচে গাঢ় দাগ, শুকনো রক্ত ছাড়া আর কোন কিছুতেই ওই দাগ হতে পারে না।
মন খারাপ হয়ে যায়, না? অনেকখানি সামলে নিয়েছে ওমর। আবার আগের অবস্থায় সরিয়ে রাখল কঙ্কালটাকে। সরানোর সময় টুপ করে কি যেন পড়ল। মেঝেতে। কুড়িয়ে নিল ওটা, অন্যেরাও কৌতূহলী হয়ে ঝুঁকে এল দেখার জন্যে।গুলি, বলল ওমর। এটাই খুন করেছিল লোকটাকে। শরীরের ভেতরেই কোথাও আটকে ছিল, নড়াচড়ায় খসে পড়েছে। স্যুভনির রাখতে চাও, বব?
নাক-মুখ বাঁকিয়ে পিছিয়ে গেল বব। দুহাত নেড়ে বলল, না, দরকার নেই।
হেসে উঠল অন্যেরা। এতক্ষণের গুরুগম্ভীর পরিবেশ হালকা হয়ে গেল হঠাৎ করে।
পিস্তলটা কোমরের বেল্টে গুঁজে রাখল ওমর। রূপার মোমদানিটা দেখিয়ে বলল, কমপক্ষে দুশো পাউণ্ড হবে এখনকার বাজারে ওটার দাম। ড্রয়ারগুলোতে কি আছে, বলতে বলতেই টান দিয়ে টেবিলের সবচেয়ে ওপরের ড্রয়ারটা খুলে ফেলল। চামড়ায় বাঁধা একটা বই তুলে নিল ড্রয়ার থেকে। আস্তে করে কভার ওল্টাল, যেন ছিঁড়ে যাবে ভয় করছে। প্রথম পৃষ্ঠাটা পড়তে শুরু করল।