মানুষের তৈরিই, জাহাজের মাস্তুল, নিশ্চয়ই গ্যালিয়নের প্রধান মাস্তুল। ফিরে চাইল ওমর। তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে কিশোর, চোখাচোখি হতেই মাথা ঝোকাল। সে-ও বুঝতে পেরেছে। এগিয়ে আসতে গিয়ে পায়ে কাঁটা ফুটল। কিশোরের। উহ্ করে নিচু হয়ে কাঁটা খুলতে গিয়ে ভারসাম্য হারাল, থাবা দিয়ে। ওমরের কাধ ধরে ফেলল। তৈরি ছিল না ওমর, সে-ও ভারসাম্য হারাল। পড়ে যেতে শুরু করল সে-ও। একটা লতা ধরল। কিন্তু দুজন মানুষের ভার রাখতে পারল না সে লতা, ছিঁড়ে গেল। পড়ে গেল দুজনেই। তাদেরকে সাহায্য করতে লাফিয়ে এল মুসা আর বব।
অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটল এই সময়। তীক্ষ্ণ চড়াৎ শব্দে ফেটে যেতে শুরু করল। যেন তলার মাটি।
আরে আরে, মাটি ফাঁক হয়ে যাচ্ছে? চেঁচিয়ে উঠল ওমর। হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। কিছু বলার জন্যে আবার মুখ খুলল, কিন্তু বলা আর হলো না। তার আগেই ভেঙে গেল নিচের তক্তা, গ্যালিয়নের শেওলায়। ঢাকা ডেকের কাঠ। ভাঙা গর্ত দিয়ে নিচে পড়ল ওমর।
বাকি তিনজনের ভারে তক্তা মড়মড় করে ভেঙে গিয়ে গর্ত আরও বড় হলো, পড়ল তারাও, আট-দশ ফুট নিচের কাঠের মেঝেতে। ওমরের ওপর পড়ল কিশোর, তাই ব্যথা বিশেষ পেল না। উহ-আহ করে উঠল অন্যেরা।
মুসা চেঁচিয়ে উঠল, গেছি রে, আল্লাহ, মারা গেছি!
সকলের আগে উঠে দাঁড়াল ওমর। হাঁপাচ্ছে। হলো কি? কাণ্ডটা কি হলো? দ্রুত তাকাল চারপাশে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনুমান করেছিল, দেখে আরও নিশ্চিত হলো এখন।
গোঁ-গাঁ করে, আরও নানারকম বিচিত্র শব্দ তুলে ককাতে ককাতে উঠে দাঁড়াল। অন্য তিনজন। কোমর ধরে বাঁকা হয়ে আল্লাহকে ডাকছে মুসা, বিড়বিড় করে কি যেন বলছে বব। কিশোর কিছু বলছে না। উঠে ওমরের মতই তাকিয়ে দেখছে। চারপাশে।
কোথায় এলাম রে, বাবা! উফ, কোমরটা বুঝি ভেঙেই গেল! বলি এলাম কোথায়? জবাব নেই কেন? এই, কিশোর… কনুই দিয়ে খোঁচা মারল মুসা গোয়েন্দাপ্রধানের পিঠে।
যা খুঁজছিলাম আমরা, জবাব দিল ওমর। হাত দিয়ে ঝেড়ে কাপড় থেকে শেওলা আর ময়লা পরিষ্কার করছে। জাহাজটার ভেতরেই পড়েছি…শশশ! হঠাৎ থেমে গেল সে, কান পাতল।
কথা শোনা যাচ্ছে, খুব কাছে। হ্যামার। স্পষ্ট শোনা গেল এখন তার কথা। আমি বলছি, শুনেছি শব্দ। এদিকেই কোথাও। মিনিটখানেক আগেও ছিল।
ঠোঁটে আঙুল চেপে ইশারায় সবাইকে চুপ থাকার নির্দেশ দিল ওমর।
নিচু হয়ে আস্তে করে মাসকেট তুলে নিল কিশোর, তার সঙ্গেই পড়েছে। বন্দুকটা। মুসারটাও পড়েছে, কিশোরের দেখাদেখি সে-ও তুলে নিল। তাকাল ওপর দিকে। ডেকের ভাঙা জায়গায় ফোকর হয়ে আছে, তবে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। ফাঁকটা, লতাপাতায় ঢেকে দিয়েছে, সবজেটে আলো আসছে ওখান দিয়ে।
হবে শুয়োর-টুয়োর কিংবা অন্য জানোয়ার, জোরাল গলা শোনা গেল ইমেট চাবের।
আমি বলছি কথা শুনেছি! হ্যামার বলল।
তাহলে আমাদের সাড়া পেয়ে পালিয়েছে। আর দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? চলো, সরে যাই। জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে আমাদের দেখছে কিনা কে জানে? পালের। গোদাটার কাছে পিস্তল আছে। ম্যাবরির মত পিঠে গুলি খাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। চলো। যাবে কোথায় ওরা? কাল সুযোগমত ধরে ফেলব। আরে, চলো না। দেবে তো মেরে।
নিশ্চয়ই দ্বিধা করছে হ্যামার, কারণ পায়ের শব্দ শোনা গেল না তক্ষুণি।
কান পেতে রয়েছে নিচের শ্রোতারা। অবশেষে ফিরল ওপরের দুজন, ধীরে ধীরে চলে গেল, বোঝা গেল শব্দ শুনেই।
আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর সঙ্গীদের দিকে ফিরে ফিসফিস করে বলল ওমর, গেছে। এই সুযোগে জাহাজটায় তল্লাশী চালিয়ে দেখি আমরা। কি বলো?
ছয়
ওমর আর তার দল জাহাজের যেখান দিয়ে পড়েছে, ববের বাবা সেখান দিয়ে পড়েনি, সে পড়েছিল স্যালুনের ছাত দিয়ে স্যালুনে। তখনকার দিকে জাহাজের স্যালুন তৈরি হত সাধারণত পূপের ওপর। ওমর আর তার তিন সঙ্গী পড়েছে। জাহাজের মাঝামাঝি জায়গায়।
ভেতরে কি কি আছে দেখায় মন দিল ওরা। এক জায়গায় পড়ে আছে কম্বলের তূপ, দীর্ঘ দিন স্যাঁতসেঁতে জায়গায় থেকে ছাতা পড়ে গেছে-সবুজ ছত্রাক। ওগুলোর কাছেই পড়ে আছে কাপড়ের তূপ, নষ্ট হয়ে গেছে সব ছাতা পড়ে। পচা গন্ধ ছড়াচ্ছে। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত কিছু নেই। মরচে পড়া কিছু অস্ত্রশস্ত্র পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, বোধহয় তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার সময় ফেলে গিয়েছিল, নাবিকেরা। মূল্যবান কিছুই নেই।
এখানে গুপ্তধন নেই, জোরে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে ওমর, বিষণ্ণ এই প্রাচীন পরিবেশ ভাল লাগছে না তার। মৃতের জগতে এসে হাজির হয়েছে যেন।
বেরিয়ে এল ওরা। নীরবে এগিয়ে চলল জাহাজের কোমর ধরে। পেরিয়ে এল বহু পুরানো কামান-ধুলো ময়লায় ঢাকা, কামানের গোলা, বারুদের পিপা-কয়েকটা আবার বারুদে বোঝাই, মোটা-শেকল, দড়ি, গাছের গুঁড়ি, খুঁটি, এমনি সব জিনিস। ওপরে জায়গায় জায়গায় চিড় ধরেছে। তক্তা, ফাটল, আবছা আলো আসছে সেসব পথে, সেই আলোয় কেমন যেন বিকট দেখাচ্ছে জিনিসগুলো, গা শিরশির করে।
গুপ্তধন ছাড়াই অনেক মূল্য জাহাজটার, বলল কিশোর, অ্যানটিক মূল্য। যে কোন যাদুঘর পেলে লুফে নেবে। এত পুরানো জাহাজ এত সংরক্ষিত অবস্থায় আর পাওয়া যায়নি। যাদুঘরে রাখলে দলে দলে আসবে দর্শক শুধু এটা দেখার জন্যেই। আমি শুনলে আমিও যেতাম। গুপ্তধন যদি না-ও পাই, বাড়ি ফিরে এই জাহাজের খবর দিলেই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাব।