মাথা ঝোঁকাল ওমর। হ্যাঁ, আশা করছি এখন নিরাপদেই যেতে পারব। ওরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। এই সুযোগে ঘুরে দেখে এলে মন্দ হয় না।
যদি ওরা টের পেয়ে যায়? মুসার জিজ্ঞাসা। যদি আক্রমণ করে?
আমরাও প্রতিহত করব। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়েই যাব। কিন্তু খুব সাবধানে ব্যবহার করতে হবে আমাদের অস্ত্র, পুরানো জিনিস, ওগুলোর বিশ্বাস নেই। নিজেরাই জখম হয়ে যেতে পারি। বব, তোমার পিস্তলে গুলি আছে?
ঠিক আছে, চলো, নিচে। কি করে গুলি ভরতে হয়, দেখিয়ে দেব। কিশোর, মুসা, তোমরা একটা করে মাসকেট নেবে।
আবার নিচে নেমে এল ওরা। যার যার অস্ত্র পছন্দ করে নিল। সব গাদা বন্দুক, গাদা-পিস্তল, কি করে গুলি ভরে গুলি করতে হয়, শিখিয়ে দিল ওমর। তারপর আবার বেরিয়ে এল চত্বরে। চট করে আরেকবার ছাতে উঠে দেখে নিল ওমর, শত্রুরা কি করছে।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে নৌকায় চড়ল সবাই। অল্পক্ষণেই পৌঁছে গেল দ্বীপের চোখা প্রান্তে। নামল। ডিঙিটা টেনে তুলে রাখল পানি থেকে দূরে, বড় একটা পাথরের খাঁজে। হ্যামার বা তার দলের কারও কোন সাড়াশব্দ নেই। নিশ্চিত হয়ে দ্বীপের ভেতরের দিকে রওনা হলো ওরা। একটা টিলার মাথায় উঠে সামনে কি আছে না আছে দেখল ওমর। ঘন জঙ্গল, ঝোঁপঝাড়, লিয়ানা লতা, বড় বড় ক্যাকটাস ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। অন্যেরাও উঠে এল তার পাশে।
মাথা নাড়ল ওমর। না, ওখানে গ্যালিয়নটা আছে বলে মনে হয় না। নাকি। বলো?
ওরকম জায়গায় থাকার কথাও না, কিশোর বলল, ভুল জায়গায় খুঁজছেন। আর যদি সত্যি সত্যি থেকে থাকে, তো ওটা থেকে মোহর বের করে আনা আমাদের কর্ম নয়। দেখেছেন কি ঘন জঙ্গল! আর্মি লাগালেও ওই জঙ্গল পরিষ্কার করতে কয়েক হপ্তা লেগে যাবে।
তবু চলো, খুঁজে দেখি, ওমর বলল। ববের বাবা তো লিখেছেনই এমন জায়গায় রয়েছে জাহাজটা, যেখানে আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। ঘন জঙ্গলেই তো ওটা লুকিয়ে থাকা স্বাভাবিক, মাস্তুল দেখা যাবে না, কিছুই দেখা যাবে না। খুঁজে বের করা খুবই কঠিন হবে, মনে হচ্ছে।
দুটো ঘণ্টা পুরোদমে খুঁজল ওরা। জঙ্গলের যেখানেই সামান্যতম ফাঁক ফোকর দেখল, ঘন লতা পাতা গাছগাছালিতে সামান্যতম ফাঁক দেখল, সেখানেই ঢু মারল। ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা উঁচু টিলায় উঠল, শুকনো খাড়িতে নামল। কিন্তু জাহাজের চিহ্নও চোখে পড়ল না।
আরও ঘন জঙ্গলে ঢোকার চেষ্টা করল ওরা, বিফল হয়ে বাদ দিল সে চেষ্টা। ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা নিচু একটা জায়গা পেরিয়ে উঠল পাহাড়ে, সেই জায়গাটায়, যেখানে ম্যাবরির তাড়া খেয়ে উঠেছিল বব।
পাথরের ওপর বসে পড়ে শার্টের আস্তিন দিয়ে কপালের ঘাম মুছল ওমর।
দূর! কি কষ্ট রে, বাবা! এমন জানলে কে আসে? বিরক্তি প্রকাশ করল মুসা।
কষ্টের কি দেখেছ? বলল ওমর। আমার তো মনে হয়, মাত্র শুরু হয়েছে।
চুলোয় যাক মোহর। চলুন, ওসব খোঁজা বাদ দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই।
যাবে কিভাবে? হাসল কিশোর।
সে তুমি জানো! চটে উঠল মুসা। তুমিই তো ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে এসেছ। তোমার জন্যেই তো…
আরে কি ঝগড়া শুরু করে দিলে ছেলেমানুষের মত? মৃদু ধমক দিল ওমর। থামো। আলো আর বেশিক্ষণ নেই, সে খেয়াল আছে? ঘরে নারকেলও আছে আর মাত্র দুতিনটে। চলো, কিছু নারকেল কুড়িয়ে নিয়ে যাই। শুকনো সরু গলা দিয়ে নামাতে সুবিধে হবে।
হ্যাঁ, নারকেল জমিয়ে রাখা উচিত আমাদের, কিশোর বলল।
বব, ওমর নির্দেশ দিল, যাও তো, চট করে ওদিকটা দেখে এসো। হ্যামার আর ইমেট চাব না আবার এদিকে এসে পড়ে। দেখো, সৈকতে কেউ আছে কিনা।
দৌড়ে গেল বব।
মুসা আর কিশোর চলল একটা নারকেল কুঞ্জের দিকে, নারকেল কুড়াতে। খুব বেশি দূরে না কুঞ্জটা, কাছেই, জঙ্গলের ধারে গজিয়ে উঠেছে। কিন্তু বারো কদম যাওয়ার আগেই থেমে গেল ওরা, পড়িমরি করে ছুটে আসছে বব। উত্তেজিত চেহারা।
হুশিয়ার! চাপা গলায় বলল বব। হ্যামার আর চাব এদিকেই আসছে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ওমর। কোথায়? কদ্দূর?
ওই যে, পাথরের স্তূপটার ওধারে। এখান থেকে ঢিল মারলে গিয়ে মাথায় পড়বে। ঝোঁপের ধারে ঝুঁকে কি জানি খুঁজছে।
মরুক হারামজাদারা! নিষ্ফল আক্রোশে ফুসল ওমর। এখান দিয়ে আর যেতে পারব না, গেলেই দেখে ফেলবে। দুর্গে ফেরাই তো এক মহাসমস্যা হয়ে গেল। মুসা আর কিশোর ফিরে এসেছে, ওদের দিকে চেয়ে উল্টোদিকে হাত তুলে। বলল, চলো, দেখি ওদিক দিয়ে যাওয়া যায় কিনা। নৌকার কাছাকাছি গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকব। ওরা একটু সরলেই ভাগব।
আগে আগে চলল ওমর, পেছনে সারি দিয়ে অন্যেরা। প্রায় ছুটে ঢুকল জঙ্গলে। একটা জায়গায় কাটাঝোঁপ আর লিয়ানা সামান্য পাতলা। নাকি পথ করা হয়েছিল। কোন এক সময়, আবার লতা আর ঝোঁপ জন্মে ঘন হয়ে আসছে? কে পথ করল? ওরা জানে না, কয়েক মাস আগে হ্যামারের তাড়া খেয়ে এখান দিয়েই ঢুকেছিল। ববের বাবা, লুকিয়েছিল এদিককার জঙ্গলেই, পথটা তৈরি করেছিল তখন।
জঙ্গলের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এসে কিসে হোঁচট খেল ওমর। গাছের মত। লম্বা কিছু একটা, শেওলায় ঢাকা, পথ জুড়ে আড়াআড়ি পড়ে রয়েছে।
আরে, কি এটা? আপনমনেই বিড়বিড় করল ওমর। ঝুঁকে পরীক্ষা করল। খানিকটা জায়গার শেওলা সরিয়ে দেখেই সন্দেহ হলো। আরও অনেকখানি জায়গার শেওলা পরিষ্কার করল। ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছ বলে তো মনে হচ্ছে না। মানুষের তৈরি না তো?