দুপদাপ করে ওপরে উঠে এল ছেলেরা, পেছনে ওমর। নৌকায় করে আনা সমস্ত মালপত্র হাতে হাতে নামিয়ে আনল ওরা ঘরে, ওমরের আনা নারকেলগুলোও আনল। কোন আসবাব নেই ঘরে, বসার কিছু নেই, মেঝেতেই বসল ওরা। কোথায় বসবে, কোথায় শোবে এ-নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাল না।
ওই ভদ্রলোকদের সামনে খাই কি করে? কেমন চেয়ে আছে দেখেছেন? কঙ্কালদুটো দেখিয়ে বলল মুসা, কণ্ঠে অস্বস্তি।
তোমারও দেখছি ভূতের ভয় আছে, হেসে বলল ওমর, ববের একার না। ওরা চেয়ে আছে তো কি হয়েছে? কঙ্কাল তো কঙ্কালই, তোমার ভেতরেও তো আছে একটা।
খেতে খেতে আলোচনা চলল। কে কিভাবে দ্বীপে নেমেছে, সেই কাহিনী খুলে বলল। মুসা আর কিশোর ভাগাভাগি করে শোনাল তাদের কাহিনী। বব শোনাল তার কিসসা, কিভাবে ম্যাবরি তার গলা কাটতে যাচ্ছিল, কিভাবে ওমর ভাই। বাঁচিয়েছে, তার বিশদ বর্ণনা। দ্রুত কাটছে সময়। দুপুর হয়ে এসেছে।
নারকেলের মালাগুলো সযত্নে সরিয়ে রাখল ওমর, কাপ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। বেশ বেকায়দা অবস্থায়ই পড়েছি, চিন্তিতকণ্ঠে বলল সে। এই দ্বীপ থেকে যেতে পারছি না আমরা, হ্যামারও পারছে না, অন্তত সিডনি বারডু যতক্ষণ না আসছে। কিন্তু প্লেন নিয়ে গেল কোথায় ব্যাটা? ফিরছে না কেন? প্রথমে ভেবেছিলাম, হ্যামারকে আটকে ফেলেছি দেখে প্লেন নিয়ে পালিয়েছে, ফিরে আসবে আমরা সরে গেলেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে কি করত? প্লেন নিয়ে কাছাকাছিই ঘোরাঘুরি করত। কিন্তু তা না করে সোজা উড়ে চলে গেল। ম্যারাবিনায়ই গেছে কিনা কে জানে। ভাবনার কথা।
ঠিকই বলেছেন, মাথা কাত করল কিশোর। আমিও সেকথাই ভাবছি।
গেছে হয়তো খাবার-দাবার আনতে, মুসা বলল। ওদের সব কিছু তো নিয়ে এসেছি আমরা।
কি করে জানল খাবার নিয়ে নিচ্ছি আমরা? ওমরের প্রশ্ন।
চুপ করে রইল মুসা, জবাব দিতে পারল না।
আমাদেরগুলো নিয়েছিল তো, বব বলল, হয়তো ভেবেছে, এত অল্প খাবারে চলবে না। তাই আরও আনতে পাঠাচ্ছিল বারভুকে। সে রওনা দেয়ার আগেই আমরা গিয়ে হাজির হয়েছি।
কিংবা হতে পারে, যন্ত্রপাতি আনতে গেছে। শাবল, কোদাল, ঝুড়ি, ইত্যাদি। মাটি খুঁড়ে গুপ্তধন তোলার জন্যে, বলল মুসা।
ওসব কিছুই আনতে যায়নি, হাত নাড়ল কিশোর। ওরা ভালমতই জানে, গুপ্তধন রয়েছে জাহাজে, মাটির নিচে নয়। শাবল-কোদালের দরকার নেই, এটা আমরা যেমন জানি, ওরাও জানে। গেছে অন্য কোন কারণে।
তোমার কি মনে হয়? মুসা প্রশ্ন করল। ভয় পেয়ে পালিয়েছে?
কিসের ভয়? ওমর বলল। ওর মত লোক ভয় পাবে? যখন জানে হাতের কাছেই কোথাও রয়েছে একগাদা মোহর? ওসব না, অন্য কোন সিরিয়াস ব্যাপার। সে যা-ই হোক, ও যদি আর ফিরে না আসে, তো আমাদের অবস্থা কাহিল। ভালমতই আটকা পড়লাম এখানে। টিনের খাবারে আর কদ্দিন চলবে? তারপর থেকে শুধু নারকেল ভরসা। তিনবেলা নারকেল খাওয়া সম্ভব? দ্বীপে যাওয়ারও অনেক বিপদ। ওখানে হ্যামার আছে, ইমেট চাব আছে, দেখামাত্র গুলি করবে। যা খাবার আছে, আমরা ধারণা, আর দুই কি তিন দিন চলবে। তারপর?
হ্যামার কোম্পানিরও তো একই সমস্যা, বলল মুসা।
কিন্তু ওদের চেয়ে আমরা খারাপ অবস্থায় রয়েছি। ঠাণ্ডা মাথায় দেখামাত্র গুলি। করতে পারব না আমরা, কিন্তু ওরা দ্বিধা করবে না।
যাক, অন্তত একটা শয়তান মরেছে, এ-ও কম না, বলল বব।
মরল আর কোথায়? হাত নাড়ল ওমর। ভেবেছিলাম মরেছে, আসলে মরেনি। তবে গুরুতর জখম হয়েছে, নড়াচড়া বিশেষ করতে পারবে বলে মনে হয়। না। চলো, ওপরে যাই, দেখি ব্যাটারা কি করছে। এখন থেকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে আমাদের, পাহারা দিতে হবে, নইলে এখানেই এসে হামলা করবে হঠাৎ এক সময়। আমরা তখন অসতর্ক থাকলেই গেছি।
ভালই লাগছে আমার এসব ডাকাত-ডাকাত খেলা, হেসে বলল বব। ট্রেজার আইল্যাণ্ড পড়ার সময় কল্পনাও করিনি, গুপ্তধন খুঁজতে এসে আটকা পড়ব আমরা। কোন দ্বীপে।
ওমরও হাসল। মজা লাগছে, না? ঠিকই বলেছ, ট্রেজার আইল্যাণ্ডের সঙ্গে অনেক মিল আছে, সত্যিই। হ্যামার হলো লঙ জন সিলভার, তার সঙ্গীরা জলদস্যু, আর আমরা… হাসি বিস্তৃত হলো তার, আমরা…হ্যাঁ, বব হলো জিম হকিনস, কিশোর স্কয়ার ট্রেলনী, মুসা ডক্টর লিভসী, আর আমি…আমি…
ক্যাপ্টেন স্মলেট, চেঁচিয়ে উঠল বব।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ওমর, নাটকীয় ভঙ্গিতে বাউ করল। তারপর ট্রেজার আইল্যাণ্ড বইয়ের সংলাপ নকল করে বলল, বান্দা আপনাদের খেদমতে হাজির, ভদ্রমহোদয়গণ। আপনাদের সহায়তায় লঙ জন সিলভারকে ফাঁসিতে না ঝোলাতে পারি তো আমার নাম ক্যাপ্টেন স্মলেট নয়। উঠুন, সবাই ডেকে যান, মন শক্ত রাখবেন। চলুন দেখি, শয়তানগুলো কি করছে।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। এমনিতেই সে ভাল অভিনেতা। ট্রেজার আইল্যাণ্ড ছবিতে দেখা স্কয়ার ট্রেলনীর ভঙ্গি হুবহু নকল করে বলল, ঠিক বলেছেন, ক্যাপ্টেন, আরেকবার আপনার বিচক্ষণতার প্রশংসা করছি। মোহরগুলো পাওয়ার আশায় রইলাম।
জোরে হেসে উঠল দর্শকরা।
সারি দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওরা ওপরে, ছাতে উঠল। ল্যাগুনের ধারে সৈকতে এখনও পড়ে রয়েছে ম্যাবরি। ওর পাশে বসে আছে হ্যামার আর ইমেট চাব।
অতো সোজা হয়ে দাড়িও না, নিচু হও, সাবধান করল ওমর, ওরা দেখে ফেলবে।
তীরে যাব? উত্তেজিত কণ্ঠে বলল বব।