দেখিনি এখনও, বলল কিশোর।
একটা গুলি তুলে নিয়ে গর্তের মুখ দিয়ে ভেতরে ছুঁড়ে দিল ওমর।
পানিতে পড়ে টুলুপ শব্দ তুলল ওটা।
হুঁ, আছে, মাথা নাড়ল ওমর। খাওয়ার যোগ্য কিনা দেখি। …ওই যে, একটা বালতি, পুরানো কাপড়-চোপড়ের মাঝে পড়ে থাকা কালো একটা জিনিস দেখাল সে। চামড়ার তৈরি, বারুদ রাখার বোতলের মতই কঠিন হয়ে গেছে এখন।
বালতি তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল কিশোর। উঠে এল পানি ভরে নিয়ে। চামড়ার বালতির জায়গায় জায়গায় ফুটো, সেগুলো দিয়ে ফোয়ারার মত পানি ছিটকে পড়ছে।
দুহাত এক করে একটা ফোয়ারার সামনে পাতল ওমর, অঞ্জলি ভরে পানি নিয়ে মুখে তুলল। ঠিকই আছে মনে হয়, মাথা দোলাল সে। কিন্তু যতক্ষণ নারকেল আছে, আমি ওই পানি গিলছি না। মুসা, ঢাকনাটা দিয়ে রাখো। পেট জ্বলছে, আমি খাবার আনতে যাচ্ছি।
ট্যাংকের দিক থেকে ফিরল ওমর, এই প্রথম খেয়াল করল যেন ছেলেদের পরনের বিচিত্র পোশাক।
পোকায় কাটা লাল একটা শার্ট গায়ে দিয়েছে কিশোর, পরনে পাজামা, হাঁটুর নিচে নেমেই শেষ, খুব টাইট-ফিটিং। মাথায় বিচিত্র টুপি, চূড়াটা অনেকটা চিমনির মত, ষোলো-সতেরোশো শতকে যেমন পরত নাবিকেরা। নীল-সাদা ডোরাকাটা শার্ট গায়ে দিয়েছে মুসা। শার্টের বুকের কাছে ছোট গোল একটা ছিদ্র, ছিদ্রের চারদিক ঘিরে খয়েরী একটা দাগ, বোঝাই যাচ্ছে কিসের। পরনে সুতি কাপড়ের ময়লা প্যান্ট। মাথায় দিয়েছে তিনকোনা একটা কালো টুপি। কিশোরের গায়ে শার্ট ঠিকমত লাগেনি, বড় হয়েছে, কিন্তু ববের একেবারে ঢলঢল করছে। রঙচটা নীল সিল্কের শার্ট গায়ে দিয়েছে, পুরানো একটা বেল্ট লাগিয়েছে কোমরে, শার্টের ওপরে, ফলে মেয়েদের ফ্রকের মত লাগছে দেখতে। বেল্টের ভেতরে আবার বিরাট পিস্তল গুঁজেছে একটা। মাথায় লাল টুপি, কানের অর্ধেক ঢেকে দিয়েছে, পেছনে লেজ নেমেছে ঘাড়ের ওপর।
হা-হাহ! ববকে দেখতে দেখতে হেসে ফেলল ওমর, চেহারায় ফোঁটাল কৃত্রিম আতঙ্ক। আরে, ইসরায়েল হ্যাণ্ডস দেখছি! এখন একটা জলি রোজার পেলেই হত। চূড়ায় উঁচিয়ে দিয়ে বুক চাপড়ে খাড়া হয়ে যেতাম। ভয়ংকর একদল জলদস্যু, দুর্গ দখল করে বসেছি।
হেসে উঠল সবাই।
স্টিভেনসনের লেখা ট্রেজার আইল্যাণ্ডের ডাকাত না ইসরায়েল হ্যাণ্ডস? বলল বব। পড়েছিলাম।
নামটা ধার নিয়েছে স্টিভেনসন, বলল কিশোর। আসল ইসরায়েল হ্যাণ্ডসও ডাকাত ছিল, খুনে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড টীচ-এর কোয়ার্টারমাস্টার।
এডওয়ার্ড টীচটা কে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
জলদস্যু ব্ল্যাকবীয়ার্ডের নাম শুনেছ?
মাথা ঝোকাল মুসা।
এডওয়ার্ড টীচের ডাক নাম ছিল ব্ল্যাকবীয়ার্ড। এতবড় খুনী লুই ডেকেইনিও ছিল কিনা সন্দেহ।
লুই ডেকেইনির নাম শুনেছি, বলল বব। আচ্ছা, কিভারে মরেছিল ডাকাতটা, বলতে পারো? ফাঁসিতে? ফাঁসি দিয়ে নিশ্চয়ই ফাঁসিকাঠেই ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল লাশটা, শুকিয়ে শুকিয়ে শেষ না হওয়াতক?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। ওর মৃত্যুটা একটা রহস্য। কেউ জানে না, কিভাবে মারা গেছে লুই ডেকেইনি। শোনা যায়, মস্ত একটা গ্যালিয়ন দখল করার পর রহস্যময়ভাবে গায়েব হয়ে যায় ডেকেইনি আর তার কিছু নাবিক। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল ওয়েস্ট ইনডিয়ান রুটের সদাগরী জাহাজের নাবিকেরা। আমার মনে হয়, ডুবে মরেছে ডেকেইনি আর তার দল। আমরা যে পোশাক পরে আছি, ডেকেইনির নাবিকদেরই কিনা, কে বলবে!
চুপ, চুপ! আঙুল নাড়ল মুসা। ওসব কথা বলো না, আমার ভয় লাগে! পরনের কাপড়গুলোর দিকে অস্বস্তিভরে তাকাল সে।
একটা কথা কিন্তু ঠিক, বলল কিশোর। রত্নদ্বীপে জলদস্যুর পোশাকে বেমানান নই আমরা।
রত্নদ্বীপ কি করে হলো? ভুরু নাচাল মুসা।
নাহলে এসেছি কেন আমরা? হ্যামারই বা পিছু নিয়ে এসেছে কেন! রত্নের লোভেই তো।
ঠিকই বলেছ, সায় দিল ওমর, রত্নদ্বীপেই এসেছি আমরা। বরং, নামটা একটু বদলে জলদস্যুর দ্বীপ রাখলে আরও মানানসই হয়। বব, যখন বলল, উভচরটা নিয়ে এখানে নেমেছে হ্যামারের দল, তখনই বুঝে নিয়েছি, এই দ্বীপেই আসতে চেয়েছিলাম আমরা।
ওমর ভাই, হাত বাড়াল কিশোর, হ্যামারের পকেট থেকে যে ম্যাপটা নিয়েছেন তাতে কিছু কিছু জায়গা বদলে দিয়েছি বটে, কিন্তু কিছু মিল আছে। আছে পকেটে? দিন তো।
পকেট থেকে ম্যাপটা বের করে দিল ওমর। কেন জানি মনে হচ্ছিল কাজে লাগতেও পারে, ঠিকই লাগল।
ভাঁজ খুলে ম্যাপটা মেঝেতে বিছাল কিশোর। ববের বাবার নির্দেশ মত, বলল সে, এই যে এখান থেকে কোয়ার্টার মাইল দূরে থাকার কথা জাহাজটা। আমি আরও সরিয়ে দিয়েছি। উপদ্বীপ থেকে কোয়ার্টার মাইল দূরে, উপদ্বীপ একটাই আছে, আর সেটাতেই রয়েছি আমরা। মূল ম্যাপে এই যে, এখানটাতে ছিল ক্রস চিহ্ন, ম্যাপের এক জায়গায় আঙুল রাখল কিশোর। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লে কেমন হয়? এসেছি মোহর খুঁজতে, খোঁজা দরকার।
যদি হ্যামার আর ইমেট চাব কাছাকাছি থাকে? মুসার প্রশ্ন।
তাহলে যাওয়া যাবে না।
দূর, যাই আর না যাই, খেয়ে তো নিই। আর থাকতে পারছি না। ওমর ভাই, টিন?
হ্যাঁ, চলো, নিয়ে আসি।
এখানে আনার কি দরকার? চত্বরে বসেই তো খেতে পারি।
না, ওখানে সাংঘাতিক রোদ। তাছাড়া ওখানে থাকলে ডাকাতদের চোখে পড়ে যেতে পারি। আমরা কোথায় আছি, ওদের না জানানোই ভাল।