ও দেখে ফেলেছে আমাদের, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর।
রিভলভার হাতে পানির ধারে দৌড়ে আসছে ইমেট চাব, যতখানি সম্ভব কাছে। থেকে গুলি করতে চায়।
আসুক, অনেক দূরে চলে এসেছি, বলল ওমর। যত ভাল হাতই হোক পঞ্চাশ গজের পরে রিভলভার দিয়ে নিশানা ঠিক রাখা খুব কঠিন।
পানির ধারে চলে এল ইমেট চাব। গর্জে উঠল তার রিভলভার। ডিঙি থেকে কয়েক ফুট দূরে পড়ল বুলেট, পিছলে উড়ে চলে গেল সা করে।
দাঁড় বাইতে বাইতে কিশোরকে বলল ওমর, গুলি করো। জানি লাগবে না, তবু অস্বস্তিতে পড়ক। পাল্টা গুলির মুখে দাঁড়িয়ে হাত স্থির রাখতে পারবে না।
গর্জে উঠল আদিম পিস্তল। পাথরে বাড়ি লেগে বিইঙ করে উড়ে চলে গেল। বল, এত দূর থেকেও সে শব্দ শোনা গেল।
কিন্তু ঘাবড়াল না ইমেট চাব, একের পর এক গুলি করে গেল। একটা গুলিও লাগাতে পারল না। ইতিমধ্যে আরও দূরে সরে এসেছে ডিঙি। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেল সে হ্যামারের বাঁধন খুলতে।
ডিঙির নাক বাঁয়ে ঘোরাল ওমর, তীরের সঙ্গে সমান্তরাল রেখে এগিয়ে চলল।
কোথায় যাচ্ছেন? জানতে চাইল কিশোর।
দ্বীপের শেষ মাথায় একটা উপদ্বীপ দেখেছ? এখান থেকে আধমাইল মত। হবে?
হ্যাঁ।
আমাদের জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। ওখান থেকে চারদিকে লক্ষ রাখতে পারব। লুকিয়ে এসে হঠাৎ আক্রমণ করতে পারবে না হ্যামারের দল। গিয়ে আগে কিছু মুখে দিয়ে নেব, তারপর মিটিঙে বসব। সামনে অনেক কাজ।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু, ওমর ভাই, ওই পোশাক কোথায় পেলেন আপনি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
কড়া হয়েছে রোদ। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছল ওমর। গেলেই দেখবে। আচ্ছা, হ্যামারের দল থেকে দূরে থাকতে পারলে না?
হঠাৎ করেই ধরা পড়ে গেলাম, ওমর ভাই, জবাব দিল মুসা। কল্পনাও করিনি ওভাবে ধরা পড়ব।
আর কোন কথা হলো না। চুপচাপ দাঁড় বেয়ে চলল ওমর। ল্যাগুনের ধারে বালিয়াড়িতে দেখা যাচ্ছে হ্যামার আর ইমেট চাবকে, ডিঙির দিকেই ফিরে আছে। ঘুরে উপদ্বীপের অন্য দিকে নৌকা নিয়ে এল ওমর, খোলা সাগরের দিকে। এখান। থেকে দেখা যায় না ল্যাগুনটা। আস্তে আস্তে দাঁড় বেয়ে ডিঙিটাকে নিয়ে এল সিঁড়ির গোড়ায়, যেখানে জাহাজ থেকে মালখালাস করা হত এককালে।
জিনিস নিয়ে উঠে যাও তোমরা, বলল ওমর।
আপনি কোথায় যাচ্ছেন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
খাবার পানি লাগবে না? দ্বীপে যেতেই হচ্ছে। কয়েকটা নারকেল কুড়িয়ে নিয়ে আসি। বেশি দেরি করব না, কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে পড়ব।
বোঝা কমে গিয়ে একেবারে হালকা হয়ে গেছে ডিঙি। নাক ঘুরিয়ে নিয়ে দ্রুত দাঁড় বেয়ে চলল ওমর।
পাঁচ
ফিরে এসে ডিঙিটা ঘাটে শক্ত করে বাঁধল ওমর। চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্যেরা, অবাক হয়ে দেখছে সবকিছু। হুড়োহুড়ি করছে, চেঁচামেচি করছে উত্তেজনায়, কিন্তু বাধা দিল না ওমর। ছেলেমানুষ ওরা, করবেই। এমন এক জায়গা, তার নিজেরই জানি কেমন লাগছে। বলে বোঝানো যাবে না, এমনি এক ধরনের উত্তেজনা, রোমাঞ্চ।
ওমর ভাই, এ-জায়গার খোঁজ পেলেন কিভাবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
খুঁজে বের করিনি, বলল ওমর। বাঁচার জন্যে উঠেছি। দেখি এই কাণ্ড। প্রথমে ভেবেছিলাম পাথরের স্তূপ, কিংবা উপদ্বীপ। বিমান থেকে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে উঠলাম। বেয়ে বেয়ে উঠে এলাম এই চত্বরে। সিঁড়িটিড়িগুলো পরে আবিষ্কার করেছি।
কিন্তু ওই পোশাক পেলেন কোথায়? জানতে চাইল কিশোর।
নিচে, সিঁড়ির দিকে আঙুল তুলে বলল ওমর। বেশ বড় একটা ঘর আছে।
আরও কাপড় আছে?
এক গাদা।
ওই সিঁড়ি দিয়েই নামা যাবে তো? মাঝে কোন বাধা-টাধা?
কিছু নেই, একেবারে পরিষ্কার। তবে অন্ধকার।
আর শোনার অপেক্ষা করল না কিশোর। মুসা আর ববকে ডাকল, চলো, দেখি।
হৈ-হৈ করে ছুটে গেল ওরা সিঁড়ির দিকে। সেদিকে চেয়ে মুচকি হাসল ওমর, চূড়ায় উঠতে শুরু করল। এটাকে পাহাড়ের চূড়া বলা যায়, নিচের ঘরটার ছাতও বলা চলে। ছাত বললেই বেশি মানানসই হবে, ভাবল সে।
চূড়া কিংবা ছাত যা-ই হোক, চমৎকার জায়গা। চ্যাপ্টা। ওপরে উঠে চারদিকে চোখ রাখতে এর জুড়ি আশপাশে আর একটিও নেই। বাইরের শত্রু যেদিক দিয়েই আসুক, এখানে বসে কেউ চোখ রাখলে, তার চোখ এড়িয়ে আসতে পারবে না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ল্যাগুনের ধারে বালিয়াড়ি। মাটিতে পড়ে থাকা কালো একটা কিছুর ওপর কে রয়েছে হ্যামার আর ইমেট চাব, বোধহয় নিগ্রোটা। হঠাৎ নিচ থেকে চেঁচামেচি শোনা গেল। ছেলেগুলোকে থামানো দরকার, তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল ওমর। কি ব্যাপার?
এটাই দেখেননি? জিজ্ঞেস করল কিশোর। হাত তুলে দেখাল আরেক ধাপ সিঁড়ি, মেঝে থেকে নিচে নেমে গেছে। কতগুলো কাপড় আর কম্বল সরাতেই বেরিয়ে পড়ল একটা চ্যাপ্টা পাথর, মাঝখানে লোহার রিঙ লাগানো। সিঁড়ির মুখ ঢাকা ছিল পাথরটা দিয়ে।
না, তখন ভালমত খুঁজে দেখিনি, বলল ওমর। তবে ওরকম কিছুর খোঁজেই নেমেছিলাম। কম্বলে ঢাকা ছিল, না?
হ্যাঁ, মেঝেতে ছড়িয়ে রাখা কয়েকটা কম্বল আর কাপড় দেখাল কিশোর, ওগুলো ছিল ওপরে।
ওরকম কিছুর খোঁজে ছিলেন মানে? প্রশ্ন করল মুসা। জানতেন, আছে ওটা?
না থাকলেই বরং অবাক হতাম।
কি এমন জিনিস…
পানি রাখার ট্যাংক। ছাত থেকে গড়িয়ে পড়ে জমা হয় ওখানে। পাথর ছাড়া কিছু নেই, এখানে যারা থাকত, পানি পেত কোথায়? মূল দ্বীপে হয়তো কোথাও আছে পানি, ঝর্নাও থাকতে পারে। কিন্তু এই দুর্গে যাদের বাস ছিল, তাদেরকে যদি পানির জন্যে বাইরে যেতে হত, নিরাপত্তা থাকত? ছাতে কোথাও না কোথাও একটা গর্ত নিশ্চয়ই আছে, বৃষ্টির পানি ওই গর্ত দিয়ে সুড়ঙ্গপথে এসে জমা হয় ট্যাংকে। তো, পানি আছে ট্যাংকটায়?