ব্যথা পায়নি রবিন কোথাও। হাঁ করে চেয়ে আছে দিমিত্রির দিকে।
দরজার দিকে ঘুরল রাজকুমার। চেয়ে রইল এক মুহূর্ত। তারপর লম্বা লম্বা পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে থামল দরজার সামনে। হাতল। ধরে হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লাল পোশাক পরা এক চাকর, চাকরদের সর্দার। কুচকুচে কালো চুল, কালো পাকানো গোঁফ।
রুকা, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কড়া গলায় বলল দিমিত্রি।
ইয়ে, মানে…ইয়োর হাইনেসের যদি কিছু দরকার হয়…
কিছু দরকার নেই। যাও। ঠিক আধঘণ্টা পর এসে প্লেটগুলো নিয়ে যাবে, খেঁকিয়ে উঠল দিমিত্রি।
মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল লোকটা, তারপর চলে গেল দ্রুতপায়ে।
দরজা বন্ধ করে দিল দিমিত্রি। ফিরে এল আবার তিন গোয়েন্দার কাছে। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, ডিউক রোজারের লোক। দরজায় কান পেতেছিল। কিছু জরুরি কথা আছে তোমাদের সঙ্গে। তোমাদের সাহায্য চাই।
চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
অনেক কিছুই বলার আছে, আবার বলল রাজকুমার। আগে খেয়ে নিই, তারপর বলব। শুধু এটুকু জেনে রাখ, চুরি গেছে রূপালী মাকড়সা!
.
০৪.
প্রায় নীরবে খাওয়া সারল ওরা।
ঠিক আধঘণ্টা পর এল চাকরের দল। টেবিল-চেয়ার, প্লেট নিয়ে চলে গেল।
বাইরে একবার উঁকি দিয়ে নিশ্চিত হয়ে এল দিমিত্রি। না, করিডরে ঘোরাফেরা করছে না আর রুকা। চলে গেছে।
ঘরে চেয়ার আছে। জানালার কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে বসল। চারজনে।
ভ্যারানিয়ার পুরানো ইতিহাস কিছু বলা দরকার আগে, শুরু করল দিমিত্রি। উনিশশো পঁচাত্তর সালে, প্রিন্স পলের অভিষেকের সময় বিদ্রোহ করে বসে কিছু উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। পালিয়ে যেতে বাধ্য হন প্রিন্স। তাকে ঠাই দেয় এক মিনস্ট্রেল (মধ্যযুগীয় পেশাদার গায়ক। পয়সার বিনিময়ে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে লোকের মনোরঞ্জন করত।) পরিবার। প্রাণের তোয়াক্কা না করে প্রিন্সকে লুকিয়ে রাখে নিজেদের বাড়ির চিলেকোঠায়। সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজল বিদ্রোহীরা। মিনস্ট্রেলের বাড়িতেও খুঁজল। পেয়ে যেত, যদি না চিলেকোঠার দরজায় জাল বুনত একটা মাকড়সা! আমাদের এখানকার চিলেকোঠা আর দরজা কেমন, বলে নিই। বাড়ির ছাতে ছোট একটা বাক্সের মত তৈরি হয় এই কোঠা, জিনিসপত্র রাখার জন্যে। নিচের দিকে একটা ডালামত থাকে, ওটাই দরজা। যাই হোক, ওই ডালার নিচে বড় করে জাল বুনেছিল মাকড়সাটা! দেখে মনে হয়েছে, অনেকদিন চিলেকোঠার ডালা খোলা হয়নি। ফলে ওখানে আর খুঁজে দেখেনি বিদ্রোহীরা।
তিনটে দিন আর রাত ওই চিলেকোঠায় বন্দি হয়ে রইলেন প্রিন্স। খাওয়া নেই, পানি নেই, কিছু নেই। জাল ছিঁড়ে যাবার ভয়ে ডালা খোলনি মিনস্ট্রেলরা, খাবার দিতে পারেনি। অবশেষে সুযোগ বুঝে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে এলেন প্রিন্স। কোনমতে গিয়ে পৌঁছুলেন গির্জায়। ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকলেন ভক্তদের, জানালেন তিনি বেঁচে আছেন। দমন হয়ে গেল বিদ্রোহ।
সিংহাসনে বসে প্রথমেই স্বর্ণকারকে ডাকালেন প্রিন্স। একটা রূপার মাকড়সা বানিয়ে দিতে বললেন। সোনার চেনে আটকে লকেটের মত ঝুলিয়ে রাখবেন গলায়। ভ্যারানিয়ার রাজপরিবারের সীলমোহরে ব্যবহার হতে লাগল মাকড়সার প্রতীক। জাতীয় প্রাণী হিসেবে মর্যাদা পেল মাকড়সা। ধরে নেয়া হল, ওই বিশেষ জাতের মাকড়সা ভ্যারানিয়ার সৌভাগ্য বহন করছে। ওদের মারা নিষিদ্ধ করে দেয়া হল। শুধু তাই না, যারা একে মারবে, রাজদ্রোহী হিসেবে গণ্য করা হবে। তাদের। এরপর থেকেই বাড়িতে রূপালী মাকড়সার জাল ছেঁড়া বন্ধ করে দিল গৃহবধূরা। যত ময়লাই করে রাখুক, প্রাণীটাকে মারে না তারা।
আমার মা ভ্যারানিয়ায় থাকলে কবে ফাঁসি হয়ে যেত, বলে উঠল মুসা। কোন আইন করেই মাকড়সার জাল ছেঁড়া বন্ধ করানো যেত না তাকে দিয়ে। মার ধারণা, মাকড়সা একটা অতি নোংরা জীব, বিষাক্ত।
অথচ, ওরা ঠিক এর উল্টো, মুসার কথার পিঠে কথা বলল কিশোর! খুবই পরিষ্কার প্রাণী। সব সময় নিজেদেরকে পরিচ্ছন্ন রাখে। সব মাকড়সাই বিষাক্ত নয়। ব্ল্যাক উইডো স্পাইডারের কথা বলতে পার, তবে ওরা শুধু শুধু কামড়ায় না। বেশি বিবক্ত করলে তো তুমিও কামড়াতে আসবে, উইডোর আর কি দোষ? টারান্টুলার এত কুখ্যাতি, কিন্তু আসলে ওরাও তত বিপজ্জনক নয়। মানুষকে এড়িয়ে চলতেই ভালবাসে। ইউরোপের বেশির ভাগ মাকড়সাই কোন ক্ষতি করে না মানুষের। বরং পোকামাকড় খেয়ে উপকারই করে।
ঠিক, একমত হল দিমিত্রি। মানুষের ক্ষতি করে এমন কোন মাকড়সা নেই ভ্যারানিয়ায়। এখানে প্রিন্স পলের মাকড়সাই সবচেয়ে বড়, খুব সুন্দর। কালোর ওপর সোনালি দাগ। বাইরে থাকতেই পছন্দ করে, তবে মাঝেসাঝে এসে ঘরের ভেতর জাল পাতে। যে জালটা তুমি। ছিঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিলে, রবিন, ওটা প্রিন্স পলের মাকড়সার। তোমাদের ঘরের ভেতর এসেছে, তারমানে শুভলক্ষণ বয়ে এনেছ তোমরা আমার জন্যে।
আমাকে বাধা দিয়ে ভালই করেছ, বলল রবিন। কিন্তু তোমার অসুবিধেটা কি?
ইতস্তত করল দিমিত্রি। তারপর মাথা নাড়ল। ভ্যারানিয়ায় কোন প্রিন্সের অভিষেকের সময় অবশ্যই ওই রূপালী মাকড়সা গলায় ঝোলাতে হবে তাকে। নইলে মুকুট পরানো হবে না। আর দুহপ্তা পরে অনুষ্ঠান, কিন্তু হবে না। আমি জানি।