বিপদ আর পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে বার বার হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছে, হয়ত সব কিছুই খুব সহজে হয়ে যাবে। কোনরকম বিপদ ঘটবে না। অভিষেক হয়ে যাবে, মাথায় মুকুট পড়বে নতুন প্রিন্স দিমিত্রি। তবে, সে আশা খুবই কম।..না না, কোন প্রশ্ন নয়। যা বলছি, শুনে যাও চুপচাপ। নিজেদের ব্যাপারে বাইরের কারোর নাক গলানো মোটেই পছন্দ করে না ভ্যারানিয়ানরা। ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে ঘুরবে তোমরা, ছবি তুলবে। সতর্ক থাকবে সব সময়। আমেরিকান এমব্যাসিতে থাকব আমি। যখন খুশি যোগাযোগ করতে পারবে। এখানেই আমার সঙ্গে তোমাদের হয়ত শেষ দেখা। আলাদা প্লেনে প্যারিসে যাব আমি, তোমাদের সঙ্গে নয়। ওখান থেকে আলাদা প্লেনে ভ্যারানিয়া। নতুন কোন কিছু জানার দরকার পড়লে রেডিওতে জানাব, ওখানে পৌঁছে। তোমাদের সাঙ্কেতিক নাম, ফার্স্ট, সেকেণ্ড এবং রেকর্ড, ঠিক আছে? কপালের ঘাম মুছেছে বব।
মাথা ঝোকানর সময় কিশোরও ঘাম মুছেছে। এয়ারকন্ডিশন ঘরেও ঘেমে উঠেছিল ওরা। ববের ভাবসাব দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল তিন গোয়েন্দা। ফিসফিস করে রকি বীচে ফিরে যাবার কথাও কিশোরকে বলেছিল মুসা একবার। স্পাইদের বিপজ্জনক কাজকারবার ছবিতে অনেক দেখেছে। নিজেরাও স্পাইয়ের কাজ করবে একদিন, কল্পনাই করেনি তখন। ভাবছে এসব কথা এখন কিশোর।
তার ক্যামেরা তুলে নিয়ে চামড়ার খাপ খুলল মুসা। খাপের ভেতরে তলায় কায়দা করে বসানো ছোট আরেকটা খাপ। ওতে একটা খুদে টেপ-রেকর্ডার। বেশ শক্তিশালী। হাতে নিয়ে ওটা একবার দেখেই রেখে দিল আবার জায়গামত।
দিমিত্রির সঙ্গে দেখা করার আগে, নীরবতা ভাঙল মুসা, একবার বব ব্রাউনের সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়? যন্ত্রপাতিগুলো সত্যি কাজ করছে কিনা, শিওর হওয়া যায়।
ভাল বলেছ, সায় দিল কিশোর। ব্যালকনিতে গিয়ে ঘড়বাড়িগুলোর একটা ছবি তুলে আনি।
ক্যামেরা হাতে ব্যালকনিতে এসে নামল কিলোর। চামড়ার খাপ খুলে বের করল যন্ত্রটা। চোখের সামনে ধরে তাকাল দূরের সেইন্ট ডোমিনিকস গির্জার দিকে। টিপে দিল রেডিওর বোতাম।
ফার্স্ট বলছি, ভিউ ফাইন্ডারের দিকে চেয়ে নিচু গলায় বলল কিশোর। ফার্স্ট রিপোর্টিং, শুনতে পাচ্ছেন?
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব এল। মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে যেন কণ্ঠস্বরের মালিক। শুনতে পাচ্ছি, বব ব্রাউনের গলা, ঠিক চেনা যাচ্ছে। কোন কথা আছে?
যন্ত্রটা পরীক্ষা করছি। প্রিন্স দিমিত্রির সঙ্গে দেখা হয়নি এখনও। একসঙ্গে নাস্তা করব।
ভাল। সতর্ক থাকবে। আমাকে সব সময়ই পাবে। ওভার অ্যাণ্ড আউট।
চমৎকার! আপন মনেই বলল কিশোর। আবার এসে ঢুকল ঘরে। ঠিক এই সময় দরজায় টোকার শব্দ হল।
দরজা খুলে দিল মুসা। দাঁড়িয়ে আছে প্রিন্স দিমিত্রি দামিয়ানি। হাসি ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখে।
দুহাত বাড়িয়ে প্রায় ছুটে এসে ঘরে ঢুকল, দিমিত্রি। খাঁটি ইউরোপীয় কায়দায় জড়িয়ে ধরল তিনজনকে। তোমরা এসেছ, কি যে খুশি হয়েছি!
অভ্যর্থনার পালা শেষ হল। জিজ্ঞেস করল দিমিত্রি, ব্যালকনি থেকে কেমন লাগল আমার দেশ?
দারুণ! বলে উঠল মুসা।
এখনও তো কিছুই দেখনি, বলল দিমিত্রি। তবে এসে যখন পড়েছ, সবই দেখতে পাবে একে একে। চল, আগে নাস্তা সেরে নিই। এ দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল দিমিত্রি। নিয়ে এস। জানালার ধারে বসাও।
ঘরে এসে ঢুকল আটজন চাকর। টকটকে লাল পোশাকে সোনালি কাজ করা। বয়ে আনল একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার আর রূপার ঢাকনা দেয়া কিছু প্লেট। জানালার দিকে এগিয়ে গেল।
বন্ধুদের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে গেল দিমিত্রি।
তুষার শুভ্র লিনেনের টেবিলক্লথ বিছাল চাকররা। তার ওপর রাখল রূপার ভারি বাসনগুলো। ঢাকনা তুলতেই ঘরের বাতাসে ভুরভুর করে। ছড়িয়ে পড়ল সুগন্ধ। আড়চোখে একবার টেবিলের দিকে না তাকিয়ে পারল না মুসা। ডিম আর মাংস ভাজা, টোস্ট মাখন, ভ্যারানিয়ান কেক! বড় জগে দুধ।
খাইছে! কত খাবার! ঢোক গিলল মুসা। দাদাভাইরা, আমি আর পারছি না। নাড়িভুড়ি সুদ্ধ হজম হয়ে যাচ্ছে খিদেয়!
হ্যাঁ হ্যাঁ, এস, তাড়াতাড়ি বলল দিমিত্রি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খালি বকর বকর করছি! এস, বসে পড়ি।…আরে, রবিন, তুমি কি দেখছ!
বেশ ছড়ানো একটা মাকড়সার জালের দিকে চেয়ে আছে রবিন। তার কাছ থেকে ফুট দুয়েক দূরে, খাটের মাথার কাছে, ঘরের এক। কোণে। দেয়ালে ঝুলছে জালটা। দেয়ালে বসানো তক্তা আর মেঝের মাঝখানের ফাঁকে উঁকি দিয়ে আছে একটা বড়সড় মাকড়সা। রবিন ভাবছে, দিমিত্রির অনেক চাকর-চাকরাণী আছে, অনেক কাজেই ওরা বিশেষ দক্ষ। তবে ঘর পরিষ্কারের কাজে ওরা ফাঁকি দেয়।
ওই যে, মাকড়সার জাল, বলল রবিন। দাঁড়াও, পরিষ্কার করে ফেলছি! পা বাড়াল সে।
তিন কিশোরকে অবাক করে লাফ দিল দিমিত্রি। প্রায় উড়ে এসে পড়ল রবিনের ওপর। এক ধাক্কায় ফেলে দিল মেঝেতে, জালটা ছিঁড়ে ফেলার আগেই।
স্তব্ধ হয়ে গেছে মুসা আর কিশোর। রবিনকে টেনে তুলল দিমিত্রি। বিড়বিড় করে বলছে কি যেন, ভ্যারানিয়ান ভাষায়!
আগেই তোমাকে সাবধান করা উচিত ছিল, আমারই ভুল হয়ে। গেছে, লজ্জিত কণ্ঠে ইংরেজিতে বলল দিমিত্রি। তাহলে আর এটা ঘটত না! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তোমাকে সময়মত রুখতে পেরেছি! নইলে সর্বনাশ হয়ে যেত! এখুনি তোমাকে ফেরত পাঠাতে হত আমেরিকায়। রবিনের কাঁধে হাত রাখল সে। হঠাৎ গলার স্বর খাদে নেমে গেল। তবে, শুভলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তোমরা আমাকে সাহায্য করতে, পারবে!