বাব্বাহ্! পুরোপুরি ভূগোলের ক্লাস! ব্যালকনিতে নেমে এসেছে কিশোর। পরনে স্পোর্টস শার্ট, বোতাম আঁটছে। সামনের দৃশ্য একবার দেখেই সমঝদারের মত মাথা নাড়ল। নাহ্, সুন্দর বলতেই হবে! সিনেমার সেটের জন্যে তৈরি করে রাখা হয়েছে যেনা মাস্টার সাব, বলতে পার গির্জাটার নাম কি? ওই যে পাহাড়ের চূড়ায়
সেইন্ট ডোমিনিকস, সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল রবিন। দেশের সবচেয়ে বড় গির্জা, একমাত্র সোনালি গম্বুজ। দুটো বেলটাওয়ার। বায়েরটাতে মোট আটটা ঘন্টা গির্জার কাজে আর জাতীয় ছুটির দিনগুলোতে বাজানো হয়। ডানের টাওয়ারে আছে মাত্র একটা। অনেক পুরানো, বি-শা-ল! নাম, প্রিন্স পলের ঘণ্টা। ইতিহাস আছে ওটার। ষোলোশো পঁচাত্তরে বিদ্রোহের সময় ওই ঘণ্টা বাজিয়ে ভক্তদের সাহায্য চেয়েছিলেন পল। জানিয়েছিলেন, বেঁচে আছেন তিনি। সাহায্য করতে ছুটে এসেছিল ক্রুদ্ধ জনতা, ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল বিদ্রোহীদের। এরপর থেকে, রাজপরিবারের কাজেই শুধু ব্যবহার করা হয় ঘণ্টাটা।
যেমন? আগ্রহী হয়ে উঠেছে কিশোর।
যখন কোন প্রিন্সের অভিষেক অনুষ্ঠান হয়, মানে মুকুট পরানো হয়, তখন একশো বার বাজানো হয় ওই ঘণ্টা, ধীরে ধীরে। যখন কোন রাজকুমার জন্ম নেয়, বাজানো হয় পঞ্চাশ বার, রাজকুমারী হলে পঁচিশ। রাজ-পরিবারে কারও বিয়ের সময় বাজে পচাত্তর বার। ঘণ্টাটার শব্দ বেশ গুরুগম্ভীর, তিন মাইল দূর থেকে শোনা যায় আওয়াজ!
মাস্টারি লাইনে গেলেই ভাল করতে, নথি, হাসল মুসা। খামোকা গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছ।
চল, তৈরি হয়ে নিই, বলল কিশোর। দিমিত্রির সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। রয়্যাল চেম্বারলেন (রাজপরিবারের লোকজন আর বাড়িঘর দেখাশোনার ভার থাকে যার ওপর। আগের দিনে আমাদের দেশে জমিদারদের যেমন সরকার থাকত অনেকটা তেমনি।) খবর দিয়ে গেছে, আমাদের সঙ্গে নাস্তা করবে প্রিন্স।
তাই তো! খাবার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম, বলে উঠল মুসা। পেটের ভেতর ছুঁচোর কেত্তন শুরু হয়ে গেছে।
তাড়াহুড়া করে লাভ হবে না, বলল কিশোর। এ তোমার নিজের বাড়ি নয় যে যা খুশি করতে পারবে। এটা রাজবাড়ি, এখানে কিছু নিয়ম-কানুন আছে। ওগুলো মেনে চলতে হবে। খিদে লাগলেই খেতে বসে যেতে পারবে না। ওদের সময় হলে ডাকবে। মুষড়ে পড়া মুসার দিকে চেয়ে হাসল। এস, বসে না থেকে যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকঠাক করে রাখি। দেখতে হবে, সত্যিই কাজ করে কিনা ওগুলো! ভুলে যেয়ো না মত্ত দায়িত্ব নিয়ে এসেছি আমরা। কিশোরের পেছন পেছন ঘরে এসে ঢুকল ওরা আবার। মস্ত একটা স্ত্র। উঁচু ছাত। পাথরের দেয়াল কাঠের তক্তায় ঢাকা। হাত পিছলে যায়, এত মসৃণ। ছয় ফুট চওড়া বিশাল এক পালঙ্ক, একটাতেই তিনজনে ঘুমিয়েছে ওরা। ওটার মাথার দিকে দেয়ালের গায়ে একটা খোদাই কাজ, রাজপরিবারের প্রতীক চিহ্ন।
একটা টেবিলের ওপর রয়েছে ওদের ব্যাগ। গত রাতে শুধু পাজামা আর টুথব্রাশ বের করেছিল।
অনেক রাতে রাজপ্রাসাদে পৌঁছেছে ওরা গতকাল। নিউ ইয়র্ক থেকে জেট প্লেনে প্যারিস, সেখান থেকে বিরাট এক হেলিকপ্টারে চেপে এসে নেমেছে ডেনজোর খুদে বিমানবন্দরে। বাইরে অপেক্ষা করছিল গাড়ি, ওদেরকে অভ্যর্থনা করে গাড়িতে তুলেছে রয়্যাল চেম্বারলেন। বিশেষ মীটিঙে ছিল তখন দিমিত্রি। বন্ধুদের সঙ্গে রাতে দেখা করতে পারেনি। অসংখ্য থাম আর অনেক গলিঘুজি পেরিয়ে (মুসার মনে হয়েছে কয়েক মাইল পথ) এই বেডরুমে পৌঁছে দিয়ে গেছে ওদেরকে চেম্বারলেন। এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ওরা, কোনমতে পোশক ছেড়ে, পাজামা পরে, দাঁত মেজেছে। তারপরই এসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে বিছানায়।
ব্যাগ খুলে জামাকাপড় বের করল ওরা। গোছগাছ করল। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরানো একটা দেয়াল আলমারিতে তুলে রাখল ওগুলো। অন্যান্য জিনিসপত্রও সব তুলে রাখল আলমারির তাকে, তিনটে জিনিস ছাড়া।
তিনটে ক্যামেরা। দেখতে আর সব ক্যামেরার মতই, তবে ছবি ভোলা ছাড়াও আরও কিছু কাজ করে ওগুলো। বেশ বড়সড়, দামি জিনিস। চাঁদিতে বিচিত্র ফ্ল্যাশার। রেডিও হিসেবেও ব্যবহার করা যায় ক্যামেরাগুলোকে। ভেতরে বসানো আছে আধুনিক সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি, শক্তিশালী একটা ওয়্যারলেস সেট। ফ্ল্যাশারটা অ্যান্টেনারও কাজ করে। ছবি তোলার ভঙ্গিতে ওই ক্যামেরা চোখের সামনে তুলে খুব নিচু গলায় কথা বললেও সেটা পৌঁছে যাবে মাইল দশেক দূরের গ্রাহকযন্ত্রে। শুধু পাঠানই না, মেসেজ ধরতেও পারে পরিষ্কার। বদ্ধ ঘরের ভেতর থেকেও এর সীমানা দুই মাইল।
মাত্র দুই ব্যাণ্ডের কমুনিকেশন, নির্দিষ্ট একটা চ্যানেলে যাতায়াত করে এর শব্দ, ঠিক ওই চ্যানেলেই টিউন করা না থাকলে কোন রেডিও বা গ্রাহকযন্ত্রই ধরতে পারবে না মেসেজ। অসাধারণ একটা যন্ত্র। ওদের জানামতে এমন আর একটা মাত্র যন্ত্র আছে সারা ভ্যারানিয়ায়, সেটা আমেরিকান এমব্যাসিতে, বব ব্রাউনের কাছে।
লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে একই প্লেনে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছে বব। সেখানে একটা বিশেষ অফিসে নিয়ে গেছে তিন কিশোরকে। যন্ত্রপাতিগুলো দিয়েছে, কি করে ব্যবহার করতে হয় শিখিয়েছে। বলেছে, ওদের কাছাকাছিই থাকবে সে সব সময়, তবে এমন ভান করবে, যেন চেনে না। যোগাযোগ করতে হলে, কোন কিছুর দরকার পড়লে, রেডিওতে জানাতে হবে। এছাড়াও রোজ রাতে নিয়মিত একবার যোগাযোগ করে খবরাখবর জানাতে হবে তাকে।