নীরব রইল তিন কিশোর। খুশি খুশি ভাবটা চলে গেছে মুসা আর। রবিনের চেহারা থেকেও।
নিরপেক্ষ একটা দেশ, এর ঘরোয়া ব্যাপারে বাইরের কারও নাক গলানো উচিত না, আবার বলল বব। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, শিগগিরই সাংঘাতিক কিছু একটা করতে যাচ্ছে ডিউক রোজার, তখন আর ঘরোয়া থাকবে না ব্যাপারটা। বুঝতেই পারছ, আমাদের অস্বস্তির যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমরা জানতে চাই, কি ঘটাতে যাচ্ছে রোজার। আমরা, বড়রা প্যালেসের ধারেকাছে ঘেষতে পারব না। দিমিত্রিও আমাদের কাছে মুখ খুলবে না কিছুতেই। তবে, তোমরা সহজেই ঢুকতে পারবে প্যালেসে, ওখানেই থাকতে পারবে, তোমাদের কাছে মনের কথা বলেও ফেলতে পারে প্রিন্স। গোলমালটা কি ঘটতে যাচ্ছে, আগেভাগে একমাত্র তোমাদের পক্ষেই জানা সম্ভব। তাছাড়া, ক্ষমতায় যারা রয়েছে, তোমাদেরকে সন্দেহ করবে না। অসতর্ক হয়ে কিছু একটা করে বসতে পারে তোমাদের সামনেই, যাতে অনেক কিছুই ফাস হয়ে যাবে।
এবারও কেউ কিছু বলল না শ্রোতারা।
তো, আসল কথায় আসা যাক, বলল বব। কাজটা নিচ্ছ। তোমরা?
কিশোরের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে রইল মুসা আর রবিন। সিদ্ধান্তের ভার গোয়েন্দাপ্রধানের ওপরই ছেড়ে দিল ওরা নীরবে।
গভীর চিন্তায় ডুবে আছে কিশোর, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে একনাগাড়ে।
রাজনীতিতে জড়ানর কোন ইচ্ছেই আমার নেই, হঠাৎ বলে উঠল কিশোর। তাছাড়া ওসব করার বয়েসও হয়নি এখনও, কিছুই বুঝি না। দেশের জন্যে ঘামানর অনেক বড় বড় মাথা রয়েছে। আমাদের কাজ ওসব নয়। তবে হ্যাঁ, আমাদের অভিভাবকদের খুলে বলতে হবে সব কথা। তারা যদি মত দেন, যাব। সে-ও শুধু প্রিন্স দিমিত্রিকে সাহায্য করতেই, আর কোন কারণে নয়।
ব্যস ব্যস, ওতেই চলবে, হাত তুলল বব। বন্ধুকেই সাহায্য কর তোমরা। তবে একটা কথা। নিজে থেকে ঘুণাক্ষরেও বিপদের আভাস দেবে না দিমিত্রিকে। সে যদি বলে, বলুক। তোমরা কি কারণে গেছ, এটাও যেন কেউ না জানে। প্যালেসের সবাই জানবে, তোমরা বেড়াতে গেছ। খবরদার, অপরিচিত কারও কাছে প্রিন্স দিমিত্রি সম্পর্কে কোনরকম আলোচনা করবে না। জানিয়ে রাখছি, আট বছর আগে এক মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তার বাবা। তখন থেকেই কোন কারণে ডিউকের উপর খেপে আছে ভ্যারানিয়ার জনসাধারণ। ওকে দেখতে পারে না তারা। যদি জানে, তোমরা স্পাই, বারুদে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি পড়বে। কাজেই চোখ খোলা রাখবে, কান সজাগ রাখবে, মুখ বন্ধ রাখবে।
তাহলে এবার অভিভাবকদের… বলতে গিয়ে বাধা পেল রবিন।
বলেছিই তো, সে ভার আমার, বলে উঠল বব। তাহলে উঠি। তোমরা যাবার জন্যে তৈরি হওগে। কালই ফ্লাইট।
.
০৩.
ভ্যারানিয়া! রাজধানী ডেনজো!
পাথরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। দেখছে প্রাচীন শহরটাকে। ভোরের সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে পুরানো বাড়িগুলোর টালির ছাতে, গাছের মাথায়। সরকারী ভবনগুলোর উঁচু টাওয়ারের চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছে সোনার পাতে মোড়া। ঝিরঝিরে বাতাসে দুলছে গাছের ডাল, প্যালেসের দিকে মাথা নুইয়ে বার বার। অভিবাদন জানাচ্ছে যেন। প্রায় আধ মাইল দূরে ছোট একটা পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল গির্জার সোনালি গম্বুজ।
নিচে তাকাল রবিন। রাজপ্রাসাদের পাথর মোড়ানো আঙিনায় কয়েকটা মেয়ে। হাতে ঝাড় আর বালতি। ঘষেমেজে পরিষ্কার করছে। প্রতিটি চৌকোনা পাথর।
পাঁচতলা পাথরের প্রাসাদের পেছনে বইছে ডেনজো নদী। চওড়া, খরস্রোতা। পুরো শহরটাকে পাক দিয়ে ঘিরে রেখেছে যেন রূপকথার বিশাল কোন রাক্ষুসে অজগর। নদীতে ছোট ছোট নৌকা, দাঁড় বেয়ে উজানভাটি করছে ধীরেসুস্থে। অপরূপ দৃশ্য। তিনতলার কোণের দিকে এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সবই চোখে পড়ছে রবিনের।
ক্যালিফোর্নিয়ার সঙ্গে কোন মিল নেই। বিশাল জানালা টপকে এসে ব্যালকনিতে নেমেছে মুসা। রবিনের পাশে এসে দাঁড়াল। অনেক পুরানো শহর! দেখেই বোঝা যায়।
তেরোশো পঁয়তিরিশ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বলল রবিন। নতুন কোথাও যাবার আগে পড়াশোনা করে জায়গাটা সম্পর্কে আলামত জেনে নেয়া তার স্বভাব। বাড়ি থেকে একটা বই নিয়ে নিয়েছিল সঙ্গে, প্লেনে বসে পড়েছে। বার বার আক্রমণ করেছে হানাদাররা, ধ্বংস করে দিয়েছে প্রতিবারেই আবার নতুন করে গড়া হয়েছে শহর। তবে, সে সবই ষোলোশো পঁচাত্তরের আগে। তারপর ঘটল বিদ্রোহ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে। সেই বিদ্রোহ দমন করেন প্রিন্স পল, রাতারাতি জাতীয় লিগ বনে গেলেন তিনি। আমাদের জর্জ ওয়াশিংটনের মত। আবার গড়ি শহর। সে-ই শেষ। এখন যা কিছু দেখছ, বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে সেই তিনশো বছর আগে। নতুন শহর একটা গড়ে উঠছে অবশ্য, তবে এখান থেকে সেটা দেখা যায় না।
পুরানোটাই ভাল লাগছে আমার, বলল মুসা। আচ্ছা, দেশটা কত বড়, বলতে পার?
মাত্র পঞ্চাশ বর্গ মাইল, বলল রবিন। খুদে একটা দেশ। ওই যে দূরে পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে, ওটা ভ্যারানিয়ার সীমান্ত। পা পাশটা পড়েছে এদেশের ভেতরে, ওপাশটা অন্য দেশ। ডেলজো উজান বেয়ে গেলে মাইল সাতে হবে। প্রচু আঙুরের ফলন হয়, এ ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে অনেক মদ চোলাইয়ের কারখানা। মসলিন জাতের মিহি কাপড় তৈরির কারখানা আছে বেশ কিছু। তবে, বেশির ভাগ বিদেশী টাকা আসে টুরিস্টদের কাছ থেকে। দেশটার অপরূপ সুন্দর দৃশ্য দেখার জন্যে আসে তারা, ভিড় করে থাকে সাব্রা বছরই। শুধু এ কারণেই, বেশির ভাগ দোকানদার আজও পুরানো ফ্যাশন জিইয়ে রেখেছে। পুরানো ধাঁচের পোশাক পরে, আচাব্র ব্যবহার, কথাবার্তার ধরনও তিনশো বছরের পুরানো—