এখন দু-এক ঘা লাগানো যায় না রোজারকে? শার্টের হাতা গোটাল মুসা। মানে, হাতের ঝাল একটু মিটিয়ে নিতাম।
হেসে ফেলল সবাই।
না, হাসতে হাসতে বলল বব। সুযোগ হারিয়েছে। জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিশ্বাসঘাতকদের সবকটা রুই-কাতলাকে। চুনোপুঁটিগুলো ছাড়াই আছে। ওরা আর কিছু করতে সাহস পাবে না।
ক্যালিফোর্নিয়ায় ইচ্ছে করেই অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাতে চেয়েছিল লিমোসিনের ড্রাইভার, বলল কিশোর। এখন এটা পরিষ্কার। ওই ব্যাটাও রোজারেরই লোক। বিশ্বাসঘাতক। প্রিন্স দিমিত্রিকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল ওরা আমেরিকায় থাকতেই।
হ্যাঁ, মাথা ঝোকাল বব। ওরা… থেমে গেল সে।
সোরগোল উঠেছে বাইরে। শোনা যাচ্ছে শ্লোগান: প্রিন্স! প্রিন্স! লঙ লিভ দ্য প্রিন্স!
সেলের দরজায় এসে দাঁড়াল দিমিত্রি। ছুটে এসে ঢুকল। জড়িয়ে ধরল বন্ধুদেরকে। তোমরা সত্যি আমার বন্ধু! তোমরা না এলে… কথা শেষ করতে পারল না রাজকুমার। ধরে এসেছে গলা।
আলিঙ্গনমুক্ত হল দিমিত্রি। মরিডোর দিকে তাকাল। ঘণ্টা বাজানর বুদ্ধিটা কার?
কিশোরের, বলল মরিডো। আমরা তো খালি-রেডিও টেলিভিশন আর খবরের কাগজের কথাই ভাবছিলাম। ঘন্টার কথা মনেই আসেনি…
ধন্যবাদ…।
…ধন্যবাদটা আসলে তোমার আর রবিনের পাওয়া উচিত, প্রিন্স, মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল কিশোর। ষোলোশো পঁচাত্তরের সেই বিদ্রোহের কথা তোমরাই বলেছিলে। নইলে জানতে পারতাম না। মাথায় ঢুকত না ঘণ্টা বাজিয়ে দেশবাসীর কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা…
যত যা-ই বল! তোমরা না এলে গিয়েছিল ভ্যারানিয়া! হাসল দিমিত্রি। প্রিন্স পল এখন বেঁচে থাকলে তোমাদেরকে মাথায় নিয়ে নাচতেন… থেমে গেল রাজকুমার।
হঠাৎ আবার বেজে উঠেছে প্রিন্স পলের ঘন্টা। বেজেই চলল, তালে তালে।
আবার বলল দিমিত্রি, সাঁঝ পর্যন্ত ঘণ্টা বাজাতে বলে এসেছি আমি! আনন্দ প্রকাশের জন্যে, জয়ের আনন্দ, চুপ করল রাজকুমার। বিষণ্ণ হয়ে গেল হঠাৎ। তবে, রূপালী মাকড়সা সঙ্গে থাকলে পরিপূর্ণ হত আনন্দ!
দিমিত্রি, বলল কিশোর। আমাকে আরেকবার সেই ঘরে নিয়ে চল। প্রাসাদে, যে-ঘরে আমরা ঘুমিয়েছি। আরেকবার দেখি চেষ্টা করে, রূপালী মাকড়সা বের করা যায় কিনা! একটা ব্যাপারে খচখচ করছে। মনের ভেতর…
তুমি জান কোথায় আছে রূপালী মাকড়সা! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। তাহলে আগে বলনি কেন?
যা উত্তেজনা গেছে, ভাবারই সুযোগ পাইনি, বলল কিশোর। তবে, ঘুমিয়ে এখন ঝরঝরে লাগছে শরীরটা। মগজের ধূসর কোষগুলো আবার কাজ করতে শুরু করেছে…চল চল, আর দেরি করে। লাভ নেই…এখুনি বেরিয়ে পড়ি…
.
রাস্তার দুপাশে লোকের ভিড়। মাঝখান দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। গাড়ি। হাত নাড়ছে জনতা। চেঁচাচ্ছে। সবারই মুখে এক কথা: লঙ লিভ দ্য প্রিন্স!–
ছলছল করছে দিমিত্রির চোখ। হাত নেড়ে তাদের সংবর্ধনার জবাব দিচ্ছে।
অনেক অনেকক্ষণ পর প্রাসাদের আঙিনায় এসে ঢুকল গাড়ি। ঘিরে ধরল সশস্ত্র প্রহরী। ওরা সবাই মিনস্ট্রেল পার্টির লোক। দিমিত্রি নামতেই দুদিক থেকে এগিয়ে এল দুজন দেহরক্ষী।
-একে একে কিশোর, মুসা আর রবিনও নেমে পড়ল। ড্রাইভারের সিট থেকে নেমে এল মরিডো। তিন গোয়েন্দার দুপাশেও এসে দাঁড়িয়ে গেল তলোয়ারধারী দেহরক্ষী। রবিনের দিকে চেয়ে সবার অলক্ষে চোখ টিপল মুসা। ভাবখানাঃ কি ব্যাপার! আমরাও প্রিন্স হয়ে গেলাম নাকি! মুচকে হাসল রবিন।
অনেক অলিগলি করিডর আর সিঁড়ি পেরিয়ে তেতলার সেই ঘরে। এসে ঢুকল ওরা। দিমিত্রি, তিন গোয়েন্দা আর মরিডো। দেহরক্ষীরা সব দাঁড়িয়ে রইল বাইরে।
এ ঘরের কোন জায়গায়ই খোঁজা বাদ দিইনি, বলল কিশোর। শুধু একটা জায়গা ছাড়া। যদি থাকে, ওই একটা জায়গাতে আছে রূপালী মাকড়সা। হয়ত আমার ভুলও হতে পারে, হয়ত পকেটেই রেখেছিল রবিন। নদীতে পড়ে গেছে…
দূর! হাত তুলল মুসা! তোমার বক্তৃতা থামাও তো, কিশোর! কোথায় আছে, বের করে ফেল!
ঠিক আছে দেখি, ঘরের কোণে এগিয়ে গেল কিশোর খাট ঘুরে। হাঁটু আর কনুইয়ে ভর দিয়ে উপুড় হল। জালটা এখনও আগের জায়গায়ই ঝুলছে। হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মাকড়সার জালের দিকে।
তক্তার প্রান্ত আর মেঝের ফাঁকে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে আছে দুটো মাকড়সা। হাত বাড়াল কিশোর। চট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল একটা মাকড়সা। আরেকটা রসেই রইল। লাল লাল চোখ।
হাত আরও সামনে বাড়াল কিশোর। আরও, আরও। নড়ল না মাকড়সা। দুআঙুলে চেপে ধরল সোনালি মাথাটা। তবু নড়ল না মাকড়সা। ধীরে ধীরে বের করে নিয়ে এল সে ওটাকে। হাতের তালুতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। হেঁটে এসে দাঁড়াল প্রিন্স দিমিত্রির সামনে।
এই যে, দেখ! তালুতে বসা মাকড়সাটা দেখাল কিশোর।
ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা, বিড়বিড় করে বলল দিমিত্রি। আসলটা!
উত্তেজিত না থাকলে প্রথমবারেই বুঝে যেতাম, বলল কিশোর। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল গার্ডেরা। লাফিয়ে এসে ঘরে ঢুকেছে মরিডো, অসাধারণ একটা বুদ্ধি খেলে গেল রবিনের মাথায়!
আমি রেখেছি! চোখ বড় বড় হয়ে গেল রবিনের।
হা! মাথায় আঘাত লাগায় ভুলে গিয়েছ। চমৎকার বুদ্ধি এঁটেছিলে! ঠিক বুঝেছিলে, মাত্র ওই একটা জায়গাতেই খুঁজবে না কেউ। খোঁজার সাহসই করবে না। মাকড়সার মাথা বেরিয়ে আছে, সেই সঙ্গে জাল, জ্যান্ত একটা মাকড়সা ঘোরাফেরা করছে জালের কাছে…নাহ, দারুণ দেখিয়েছ, নথি!