দেশের শত্রু! অফিসারদের দিকে চেয়ে বলল প্রহরীদের ক্যাপ্টেন। হাজতে ভরে রাখুন। পরে, ডিউক রোজার যা করার করবেন।
দ্বিধা করতে লাগল দুই অফিসার।
প্রিন্স পলের ঘণ্টা… বলতে গিয়েও থেমে গেল এক অফিসার।
রিজেন্টের আদেশ! খেঁকিয়ে উঠল ক্যাপ্টেন। বোঝা গেল, পুলিশের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে রয়্যাল গার্ডকে। অনেকটা সেনাবাহিনীর মত। সরুন! পথ ছাড়ন!
সরে দাঁড়াল দুই অফিসার। বন্দিদেরকে নিয়ে একটা হলে এসে ঢুকল প্রহরীরা। অন্য পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল করিডরে। দুটো করে দুপাশে চারটে ছোট ছোট সেল। লোহার শিকের দরজা। একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিল মুসা আর মরিডোকে। আরেকটাতে কিশোর আর রবিন। বন্ধ করে দিল দরজা।
তালা আটকান, পেছনে আসা পুলিশ অফিসারের দিকে চেয়ে আদেশ দিল ক্যাপ্টেন। ভালমত পাহারার ব্যবস্থা করুন। এখান থেকে ওরা পালালে, কপালে দুঃখ আছে আপনাদের।…আমরা যাচ্ছি। রিজেন্টকে খবর দিতে হবে।
বেরিয়ে গেল প্রহরীরা।
প্রতিটি সেলে দুটো করে বাংক। এগিয়ে গিয়ে একটাতে বসে পড়ল মরিডো। ধরা শেষতক পড়লামই! তবে, আর কিছু করারও ছিল না আমাদের। প্রাসাদে কি ঘটছে, কে জানে!
কোন জবাব দিল না মুসা। অন্য বাংকটাতে গিয়ে বসে পড়ল, চুপচাপ।
সারারাত জেগেছি, বাংকে বসে বলল কিশোর। ধকলও গেছে সাংঘাতিক! শরীরে আর সইছে না। যা হবার হোকগে পরে, আগে ঘুমিয়ে নিই… শুয়ে পড়ল সে।
রবিনও হাই তুলতে লাগল। চোখ ডলল দুহাতে। আর কিছুই করার নেই। সে-ও শুয়ে পড়ল বাংকে।
শুয়ে শুয়ে বিড়বিড় করতে লাগল কিশোর, শত শত বছর আগে একবার বাজানো হয়েছিল এভাবে, আজ আবার আমরা বাজালাম! রেডিও-টেলিভিশনের চেয়ে অনেক অনেক পুরানো মাধ্যম! আজকাল অনেক জায়গাতেই এটা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে প্রথম নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৪৫৩ সালে, তুর্কীরা কনস্টান্টিনোপল অধিকার করার পর…এই রবিন, শুনছ…
সাড়া দিল না রবিন। ঘুমিয়ে পড়েছে।
চোখ মুদল কিশোর।
.
১৭.
গাঢ় অন্ধকার। পা পিছলে নর্দমার পানিতে পড়ে গেছে রবিন। ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে তাকে তীব্র স্রোত। হাত-পা নেড়ে ভেসে থাকার চেষ্টা, করছে সে। বার বার বাড়ি খাচ্ছে সুড়ঙ্গের দেয়ালে। একবার এপাশে, একবার ওপাশে। বহুদূর থেকে যেন ভেসে এল কিশোরের ডাক, রবিন! এই, রবিন!
উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে রবিন। পারছে না। কাঁধ চেপে ধরল একটা হাত। কানের কাছে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, রবিন! চোখ মেল! ওঠ!
চোখ মেলল রবিন। মিটমিট করে তাকাল। প্রথমে বুঝতে পারল না কোথায় রয়েছে। মুখের ওপর ঝুঁকে আছে কিশোরের মুখ। হাসছে।
রবিন! দেখ কে এসেছে। ওঠ, উঠে বস!
উঠে বসল রবিন। কিশোর সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। নজরে পড়ল বব ব্রাউনের হাসি হাসি মুখ।
দারুণ কাজ দেখিয়েছ, রবিন! এগিয়ে এল বব। রবিনের কাঁধে। হাত রাখল। তোমরা সবাই! এতটা আশা করিনি!
চোখ মিটমিট করে ববের দিকে তাকাল রবিন। প্রিন্স দিমিত্রি? সে ভাল আছে?
খুব ভাল। এই এসে পড়ল বলে, বলল বব। ডিউক রোজার, তার প্রধানমন্ত্রী এবং দলের আর সবাইকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। রোজার আর লুথারকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়েছে জনতা। প্রিন্স দিমিত্রি ঠিক সময়ে এসে না পড়লে, মেরেই ফেলত। মরিডোর বাবাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আবার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন তিনি…
উল্টোদিকের সেলের দরজা খোলার শব্দ হল। বেরিয়ে এল মুসা আর মরিডো। এই সেলে এসে ঢুকল। পেছনে এল দুই পুলিশ অফিসারের একজন। হাসি একান-ওকান হয়ে গেছে দুজনেরই।
ঘণ্টা বাজানর পর কি কি হয়েছে, নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করছে। তোমাদের, না? চারজনের দিকেই তাকাল একবার বব।
মাথা ঝোঁকাল তিন গোয়েন্দা।
তোমাদের সঙ্গে হঠাৎ রেডিও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল, বলল বব। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। আজ ভোরে আর থাকতে না পেরে অ্যামব্যাসাডর সাহেবকে নিয়ে বেরিয়েই পড়লাম। প্রাসাদের মেইন গেট বন্ধ। তালা দেয়া। গেটের ওপাশে গার্ড। ভেতরে ঢুকব, বললাম। গেট খুলল না ওরা। ডিউক রোজারের হুকুম, খোলা যাবে না, বলল। এর পরেও দরজা খোলার জন্যে চাপাচাপি করছি, এই সময় বেজে উঠল প্রিন্স পলের ঘণ্টা। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল রাস্তার লোক। তারপর, বেজেই চলল ঘণ্টা। পিলপিল করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মানুষ। বন্যার মত ধেয়ে এল প্রাসাদের দিকে। গেট খুলে দিতে বলল গার্ডদেরকে। প্রিন্স দিমিত্রির কি হয়েছে, জানতে চাইল। ওদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারল না গার্ডেরা। ব্যস, খেপে গেল জনতা। ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেলল গেট। ঢুকে পড়ল আঙিনায়। হাতে গোনা কয়েকজন গার্ডের সাধ্য হল না সে জনস্রোতকে থামান। দেখতে দেখতে ভরে গেল আঙিনা। বারান্দায় উঠে পড়ল গার্ডেরা। ঠিক এই সময়, দোতলায় রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল এক প্রহরী। চেঁচিয়ে বলল জনতাকে, প্রিন্স দিমিত্রি সাংঘাতিক বিপদে পড়েছে। তাকে যেন উদ্ধার করে তারা। কয়েদখানায় প্রিন্সকে আটকে রেখেছে শয়তান ডিউক রোজার। ভয়ানক এক ষড়যন্ত্র করেছে। ব্যস, আমিও পেয়ে গেলাম সুযোগ, হাসল বব। উঠে দাঁড়ালাম গাড়ির ছাতে। ভ্যারানিয়ান ভাষা জানি। শুরু করলাম শ্লোগান: প্রিন্স দিমিত্রি! জিন্দাবাদ! ডিউক রোজার! নিপাত যাক। থামল সে। তারপর বলল, এমনিতেই ডিউক রোজারকে দেখতে পারে না। জনসাধারণ। গতরাতে রেডিও-টেলিভিশনে বারবার ঘোষণা করা হয়েছে, সকাল আটটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবে রোজার। প্রাসাদের গেট তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ বেজে উঠেছে প্রিন্স পলের ঘণ্টা। দোতলায় গার্ডের সাহায্যের আবেদন, আবার শ্লোগান…দুইয়ে দুইয়ে। ঠিক চার মিলিয়ে নিল জনতা। বারুদে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি পড়ল যেন। গার্ডদের আক্রমণ করে বসল ওরা। তারপর যা একখান দৃশ্য! বলে বোঝাতে পারব না! প্রাসাদে ঢুকে পড়ল জনতা। চাপের মুখে প্রিন্স দিমিত্রিকে কোথায় আটকে রেখেছে, দেখিয়ে দিতে বাধ্য হল গার্ডেরা। বের করে আনা হল তাকে। সত্যি, প্রিন্স বটে! ওইটুকু ছেলে! অথচ বেরিয়েই কি সুন্দর থামিয়ে ফেলল সব গোলমাল। রোজার আর লুথারকে অ্যারেস্ট করার আদেশ দিল। বেগতিক দেখে দল বদল করল গার্ডেরা, যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এবার বিশ্বাসঘাতকতা করল ওরা দুই ডিউকের সঙ্গে। ওদেরকে ধরে আনতে ছুটল। গিয়ে দেখল ঘরের দরজা ভাঙা। দুজনকে ধরে বেদম পেটাচ্ছে জনতা। কোনমতে উদ্ধার করে আনা হয়েছে ওদেরকে। তারপর আর কি? দোতলায় দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে মিনিট দুয়েক ভাষণ দিল প্রিন্স। থেমে গেল। সব গোলমাল।