গমগমে ভারি একটা শব্দ উঠল। কানে তালা লেগে যাবার জোগাড় হল ছেলেদের! রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে রবিন আর মুসা। নিচে চেয়ে দেখল, রাস্তার সবাই মুখ তুলে তাকিয়েছে এদিকে।
কানের বারোটা বেজে যাবে! বলে উঠল কিশোর। রবিন, তোমার পকেটে রুমাল আছে না?
আছে? এই নাও, বের করে দিল রবিন।
দ্রুত হাতে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করল কিশোর রুমালটা। দুটো টুকরো ঢুকিয়ে দিল, নিজের কানে। দুটো দিল রবিনকে। চারটে করে দিল মুসা আর মরিডোকে। ওরা কানে আঙুল দিতে পারবে না। কাজেই ভালমত বন্ধ করে নিতে হবে কানের ফুটো।
নিচে দরজার কাছ থেকে আসছে জোর আওয়াজ। কুড়াল এসে গেছে। ভেঙে ফেলবে শিগগিরই দরজা।
একনাগাড়ে ঘন্টা বাজিয়ে যেতে ইশারা করল কিশোর।
আবার বেজে উঠল ঘণ্টা। আবার, তারপর আবার। বেজেই চলল। তাল ঠিক নেই! আওয়াজটাও অনেক বেশি চড়া। বেশ দূর থেকে গিয়ে কানায় আঘাত হানছে দোলক, তাই। কান ফাটানো শব্দে ঘোষণা করে চলল যেন ঘণ্টাটা: হুশিয়ার! হুশিয়ার!
কানে আঙুল দিয়ে রেখেছে কিশোর আর রবিন। তবু রেহাই পাচ্ছে না। মাথার মগজসুদ্ধ যেন ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে প্রচণ্ড শব্দ। মুসা আর মরিডোর অবস্থা কল্পনা করতে পারল ওরা। নিচে থেকে দরজা ধাক্কানর শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর। শোনা যাচ্ছে না কিছুই। সারা পৃথিবী জুড়ে আছে যেন শুধু একটাই শব্দ-প্রচণ্ড ঢ-অ-ও-ও! ঢ-অ–ঙ!
টাওয়ারের নিচে রাস্তায় জমা হতে শুরু করেছে লোক, রেলিঙে দাঁড়িয়ে দেখছে কিশোর আর রবিন। পিল পিল করে লোক বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে অন্যান্য রাস্তায়, সবাই চেয়ে আছে গির্জার দিকে। কেউ কেউ উত্তেজিতভাবে প্রাসাদের দিকে দেখাচ্ছে হাত তুলে। মেসেজটা কি পাবে ওরা? বুঝতে পারবে, প্রিন্স দিমিত্রির বড় বিপদ?
টাওয়ারের নিচে জনতার মাঝে হঠাৎ একটা আলোড়ন উঠল। যাচ্ছে সবাই। হাঁটতে শুরু করল। রওনা হয়ে পথ ধরে, সম্ভবত প্রাসাদেই চলল ওরা।
দেখতে দেখতে জনতার ঢল নামল, যেন শহরের পথে পথে। আর তাকাচ্ছে না ওরা গির্জার দিকে। সোজা এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্য, রাজপ্রাসাদ। হাসি ফুটল কিশোর আর রবিনের মুখে।
হাজারে হাজারে লোক জমে গেছে প্রাসাদের সামনে। প্রধান ফটকের সামনে ভিড়। একদল লাল কাপড় পরা পুতুল, চোখে পড়ল কিশোর আর রবিনের। নড়ছে ওগুলো। কিন্তু কয়েকটা সেকেণ্ড। জনতা-পুতুলের ধাক্কায় স্রোতের মুখে কুটোর মত ভেসে গেল যেন লাল ইউনিফর্ম পরা প্রহরীরা। আঙিনায় ঢুকে পড়তে শুরু করল জনতা।
মেসেজ পেয়ে গেছে তাহলে দেশবাসী!
হঠাৎ থেমে গেল ঘণ্টাধ্বনি। দড়ি ছেড়ে দিয়েছে মরিডো আর মুসা, কিশোর আর রবিনের পাশে এসে দাঁড়াল। ওরাও দেখতে চায়, কি ঘটছে। জনতার দিকে চেয়ে ওদের মুখেও হাসি ফুটল।
ঘড়ি দেখল মুসা। পকেট থেকে খুদে রেডিওটা বের করে নব ঘুরিয়ে দিল।
কোন শব্দ ঢুকল না কানে। ভুরু কুঁচকে তাকাল মুসা রেডিওর দিকে। চোখ তুলতেই দেখল, কানের ভেতর থেকে রুমালের টুকরো বের করছে কিশোর।
কানের ফুটো থেকে রুমালের টুকরো বের করে নিল সবাই। শোনা। গেল ভারি একটা কণ্ঠস্বর। ভ্যারানিয়ান ভাষা। ডিউক রোজার! নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ভাষণ শুরু করে দিয়েছে?
চুপচাপ শুনল কিছুক্ষণ মরিডো, তারপর অনুবাদ করে শোনাল তিন গোয়েন্দাকে: ডিউক রোজার! বলল, সাংঘাতিক এক বিদেশী ষড়যন্ত্র ধরা পড়েছে। অভিষেক অনুষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্যে স্থগিত। শাসনভার পুরোপুরি নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। শিগগিরই আসামীদের ধরে হাজির করবে দেশবাসীর সামনে। রূপালী মাকড়সা গায়েব। প্রিন্স দিমিত্রিকে নজরবন্দি করা হয়েছে। দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে ডিউক।
কাম সারছে! বলে উঠল মুসা। এমনভাবে বললেন, আমারই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে! আল্লাই জানে, কি হবে!
কিন্তু ডেনজোর অনেকেই শুনছে না তার ভাষণ! বলল মরিডো। ছুটে যাচ্ছে প্রাসাদের দিকে। ঘন্টা কেন বাজল, এটাই হয়ত জানতে চায়…চমকে উঠে থেমে গেল সে। এ দরজা ধাক্কানোর শব্দ। দুটো দরজা ভেঙে ফেলেছে প্রহরীরা। পৌঁছে গেছে তৃতীয় দরজার ওপাশে।
দরজা খোল! চেঁচিয়ে উঠল একটা ভারি কণ্ঠ। রিজেন্টের আদেশে অ্যারেস্ট করা হল তোমাদের
দরজা ভেঙে আস! চেঁচিয়ে জবাব দিল মরিডো। আমরা খুলব না! সঙ্গীদের দিকে ফিরে বলল, আসুন। আবার বাজাই। ওরা ঢোকার চেষ্টা করুক, আমরা বাজিয়ে যাই।
আবার কানে রুমালের টুকরো ঢোকাল ওরা।
আবার বাজতে শুরু করল ঘন্টা। মাত্র কয়েক ফুট দূরে কুড়ালি আর ক্রোবার নিয়ে দরজা আক্রমণ করেছে প্রহরীরা। সে শব্দ চাকা পড়ে গেছে প্রচণ্ড ঘণ্টাধ্বনিতে!
হঠাৎ ভেঙে পড়ল দরজা।
.
১৬.
আগেপিছে প্রহরী। সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলল ছেলেরা। ক্লান্ত।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে প্রহরী। গোল একটা বেষ্টনী তৈরি করে দাঁড়াল। তার মাঝে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়া হল ছেলেদেরকে।
গির্জা থেকে বের করে আনা হল চার বন্দিকে। রাস্তায় এখনও লোক আছে, তবে খুবই কম। কৌতূহলী চোখে তাকাল ওরা। কি হচ্ছে না হচ্ছে বুঝতে পারছে না কিছুই। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল কয়েকজন। প্রহরীদের ধমক শুনে পিছিয়ে গেল আবার।
চারপাশ থেকে বন্দিদেরকে ঘিরে নিয়ে সার্চ করে এগোল প্রহরীরা। দুটো ব্লক পেরিয়ে এসে থামল একটা পাথরের বাড়ির সামনে। ওটা থানা। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দুজন নীল পোশাক পরা পুলিশ অফিসার।