দ্বিতীয় দরজাটা পেরিয়ে এল ওরা। ছিটকিনি তুলে দিল কিশোর। এই সময় কানে এল প্রথম দরজায় ধাক্কার আওয়াজ।
আরও তাড়াতাড়ি করতে হবে। বেলটা বাজানোর আগেই যদি দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে প্রহরীরা, তাহলে এত কষ্ট সব বিফলে যাবে।
সময় খুব বেশি পাব না আমরা! জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর। এর মাঝেই কাজ সারতে হবে!
তৃতীয় দরজা খুলে ফেলল কিশোর। রবিনকে নিয়ে মরিডো আর মুসা ঢুকে যেতেই সে-ও ঢুকে পড়ল। তুলে দিল ছিটকিনি। হাঁপ ছাড়ল। চমকে উঠে উড়ে গেল এক ঝাঁক পায়রা।
কংক্রীটে তৈরি গোল একটা চত্বরে এসে দাঁড়াল ওরা। খোলা। রেলিঙে ঘেরা। চত্বরের ঠিক মাঝখানে বেশ বড় গোল একটা ফোকর।
ফোকরের কাছে এগিয়ে গেল মরিডো। নিচে তাকাল। অনেক নিচে পুতুলের মত দেখাচ্ছে প্রহরীদেরকে। দড়িটা টান দিয়ে তুলে নিল সে। ঝট করে ওপরে তাকাল প্রহরীরা। কিন্তু দড়িটা চলে এসেছে তাদের নাগালের বাইরে।
প্রথম দরজাটা ভাঙার চেষ্টা করছে ওরা, বলল মরিডো। শিগগিরই শাবল কুড়াল নিয়ে আসবে গিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘণ্টাটার দিকে তাকাল সে। কিন্তু যা ভারি! বাজাব কি করে! নড়াতেই তো পারব না!
চিন্তিত চোখে ঘণ্টার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। কি বিশাল! মোটা দুটো থামের মাথায় লোহার দণ্ডে ঝোলানো। চারদিক থেকে ঘণ্টাকে ঘিরে উঠে গেছে শক্ত কাঠের আরও কয়েকটা থাম। ওগুলোর মাথায় বসানো চোঙের মত টিনের চাল। রোদ-বৃষ্টি থেকে ঘণ্টাকে বাঁচায়। ঘণ্টার চূড়ায় মোটা একটা রিঙ। তাতে বাধা দড়ির আরেক প্রান্ত। দড়ি ধরে টানলেই দুলতে শুরু করে ঘণ্টা, ভেতরে নড়ে ওঠে দোলক। তালে তালে ঘণ্টার গায়ে বাড়ি মারে, একবার এপাশে, একবার ওপাশে। যেমন ঘণ্টা তেমনি তার দোলক। বিশাল, ভারি।
রবিনও দেখছে ঘণ্টাটাকে। ভেতরের দিকে ঘণ্টার নিচে টুপির মত ছড়ানো অংশে নানারকম সূক্ষ্ম কারুকাজ, খোদাই করা। দেখলে শ্রদ্ধা। বেড়ে যায় প্রাচীন শিল্পীর ওপর, যে করেছিল কাজগুলো।
রেলিঙের কাছে এগিয়ে গেল রবিন। নিচে তাকাল। প্রায় পুরো ডেনজো শহরটাই চোখে পড়ছে। এখান থেকে দেখলে মনে হয় একটা লিলিপুটের দেশ। খুদে মানুষ, খুদে গাড়ি। শহরের পরিবেশ শান্ত। দেখে মনে হয় না, কি সাংঘাতিক এক ষড়যন্ত্র চলছে ভেতরে ভেতরে! মনেই হয় না, প্রাণের ভয়ে ওরা এসে পালিয়েছে এখানে। নিচে প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছে ঘাতকরা ওদের ধরার। পাশে তাকাল। নিচে। এখন সেইন্ট ডোমিনিকসের সোনালি গির্জা। এখান থেকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। বিশাল এক বাটি যেন উপুড় করে ফেলে রাখা হয়েছে, পিঠটা চোখা।
হায়, আল্লাহ! খামোকাই এলাম! বলে উঠল মুসা। বাজাব কি করে ওটা!
ফিরে তাকাল রবিন।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে হঠাৎ ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিল কিশোর। পেয়েছি! সাধারণ নিয়মে ঘন্টাটা বাজাতে পারব না। আমরা। দড়ি ধরে টেনে কাত করে ফেলতে হবে। তারপর দোলকে দড়ি বেঁধে দোলাতে হবে ওটাকে। বাড়ি লাগবে ঘণ্টার গায়ে। এস, কাজে লেগে পড়ি।
চারজনেই দড়ি ধরে টান দিল। নড়ে উঠল ঘণ্টা, খুবই সামান্য।
জোরে! আরও জোরে! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
আরেকটু কাত হল ঘণ্টা।
হ্যাঁ, হবে। ছেড়ে দাও! বলল কিশোর।
কিশোর ছাড়া আর সবাই ছেড়ে দিল। দড়িটা নিয়ে গিয়ে। একপাশের একটা সরু থামের উল্টো পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে আনল সে। তারপর আবার সবাইকে ধরে টানার নির্দেশ দিল।
একটু একটু করে কাত হতে শুরু করল ঘণ্টা। দোলকটা সরে যেতে লাগল ঘণ্টার এক কানার দিকে। সামান্য একটু ফাঁক থাকতেই চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, এবার দড়ি পেচিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে থামের সঙ্গে!
বেঁধে ফেলা হল দড়ি। কাত হয়ে রইল ঘণ্টা।
আবার হাঁপাতে শুরু করল ওরা। ঘামে নেয়ে উঠেছে শরীর। টিনের চালে আবার নেমে এসেছে পায়রাগুলো। বাক-বাকুম বাক-বাকুম শুরু করে দিয়েছে।
নিচে, প্রথম দরজায় ধাক্কার শব্দ থেমে গেছে।
নিশ্চয় কুড়াল আনতে গেছে ব্যাটারা! বিড়বিড় করল মরিডো।
কটা বাজে, মুসা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আটটা বাজতে বিশ।
হু। তাড়াতাড়ি করতে হবে। ডিউক রোজার ভাষণ দেবার আগেই শহরবাসীকে হুঁশিয়ার করে দেব।…মরিডো, দড়িটা দিন।
দড়ি!…
কোমরে পেঁচানো…
ও, হ্যাঁ! ভুলেই গিয়েছিলাম! চাদরে তৈরি দড়িটা কোমর থেকে খুলে দিল মরিডো।
দোলকে বেঁধে দিতে হবে। ওটা ধরেই টানব।
এক মুহূর্ত স্থির চোখে কিশোরের দিকে চেয়ে রইল মরিডো। অনেকক্ষণ পর এই প্রথম হাসল। সত্যি, আপনি বুদ্ধিমান…
আহ্, তাড়াতাড়ি করুন…।
কিন্তু ওখানে উঠব কি করে?
কিশোর, বুদ্ধি বাতলে দিল মুসা। আমি আর মরিডো পাশাপাশি দাঁড়াচ্ছি। তুমি আমাদের কাঁধে চড়ে উঠে যাও।
ঠিক আছে।
দোলকটার তলায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে পড়ল মুসা আর মরিডো। ওদের কাঁধে উঠে পড়ল কিশোর। দড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়াল। দোলকের সঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে দিল দড়ির এক মাথা। তারপর লাফিয়ে নেমে এল। যাক, অনেক কাজে লাগল দড়িটা!
মনে হচ্ছে ওদের, কত সময় পেরিয়ে গেছে! অথচ ঘণ্টাঘরে ঢোকার পর পেরিয়েছে মাত্র দেড় মিনিট।
আবার শব্দ শোনা গেল দরজায়।
দেরি করে লাভ নেই, বলে উঠল মুসা। এস, শুরু করে দিই।
দড়ি ধরল মুসা আর মরিডো। চারজনের মাঝে ওদের দুজনের গায়েই জোর বেশি। আস্তে করে টেনে কানার কাছ থেকে দোলকটা সরিয়ে আনল ওরা। তারপর হঠাৎ ঢিল দিল দড়িতে। প্রচণ্ড জোরে গিয়ে ঘণ্টার গায়ে আঘাত হানল ভারি দোলক।