পৌঁছে গেল প্রহরীরা। দরজায় ধাক্কা দিতে আরম্ভ করল। সেই সঙ্গে ক্রুদ্ধ চেঁচামেচি।
মুহূর্তের জন্যে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আনল রবিন। বিশাল চার দেয়াল, ওপরে ছাত আছে বলে মনে হল না। তবে আকাশও দেখা যাচ্ছে না পুরোপুরি। কিছু একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখের সামনে। একপাশের দেয়াল ঘেঁষে ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে লোহার সিঁড়ি। ওপর থেকে নেমে এসেছে আটটা লম্বা দড়ি। সিঁড়ির পাশে দেয়ালে গাঁথা লোহার আঙটার সঙ্গে বাঁধা রয়েছে প্রান্তগুলো।
আর কিছু দেখার সময় পেল না রবিন।
ক্যাটাকম্বের দিকে যেতে হবে, কানে এল রিবাতোর কথা। লুকিয়ে থাকতে হবে ওখানেই…
ক্যাটাকম্ব কি, রবিনের জানা আছে। গির্জার ভেতরে মাটির তলায়। ভাঁড়ারের মত বড় বড় ঘর। কফিনে ভরে লাশ নিয়ে রেখে দেয়া হয় ওসব ঘরে। বড় বড় গির্জায় মাটির নিচেও থাকে একাধিক তলা। তাতে অসংখ্য ঘর, অসংখ্য করিডর, সিঁড়ি, অন্ধকার!
কি হবে ওখানে গিয়ে? বলে উঠল কিশোর। ওরা ঠিক বুঝে। যাবে, কোথায় গেছি আমরা। বাতি নিয়ে এসে সহজেই খুঁজে বের করবে।
সবাই চোখ তুলে তাকাল কিশোরের দিকে।
কিছু একটা ভাবছ তুমি, কিশোর! বলল মুসা। কি?
ওই দড়িগুলো, হাত তুলে দেখাল কিশোর। ওগুলো টেনে প্রিন্স পলের ঘণ্টা বাজানো যায়?
প্রিন্স পলের ঘণ্টা! অবাক হয়ে তাকাল মরিডো। কিশোরের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। না, ওগুলো সাধারণ ঘণ্টার দড়ি। প্রিন্স পলের ঘণ্টা রয়েছে অন্য টাওয়ারটাতে। ওপাশে। একটাই ঘণ্টা। বিশেষ বিশেষ সময়ে কেবল বাজানো হয়।
শুনেছি, দ্রুত বলল কিশোর। প্রিন্স দিমিত্রির কাছে শুনেছি, শত শত বছর আগে আরেকবার অভ্যুত্থান হয়েছিল ভ্যারানিয়ায়। ওই ঘণ্টা বাজিয়ে দেশবাসীর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন প্রিন্স পল।
হাঁ করে অন্য পাঁচজন চেয়ে আছে কিশোরের মুখের দিকে।
চোয়ালের একপাশ চুলকাল রিবাতো। হ্যাঁ। ভ্যারানিয়ায় বাচ্চা ছেলেরাও জানে একথা। কিন্তু তাতে কি?
উনি বলতে চাইছেন, প্রিন্স পলের মতই গিয়ে আমরাও বাজাব ওই ঘণ্টা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। সাহায্য চাইব প্রিন্স দিমিত্রির জন্যে! ইসস, কেউ ভাবিনি আমরা এ কথাটা! খালি খবরের কাগজ, রেডিও আর টেলিভিশনের দিকেই ছিল খেয়াল! অনেক দিন বাজেনি ওই ঘণ্টা! যদি আজ হঠাৎ করে…
..বাজতে শুরু করে, মরিডোর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল মেরিনা, চমকে উঠবে লোকে! দেশবাসী ভালবাসে প্রিন্স দিমিত্রিকে। দলে দলে ছুটে যাবে তারা প্রাসাদের দিকে। জানতে চাইবে, কি হয়েছে!
কিন্তু যদি… শুরু করেই থেমে গেল রিবাতো।
আর দেরি নয়! চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। দরজায় আওয়াজ শুনছ! ভেঙে ফেলবে শিগগিরই! যা করার জলদি করতে হবে!
ঠিক আছে! আর দ্বিধা করল না রিবাতো। মরিডো, তুমি এঁদেরকে নিয়ে যাও! আমি আর মেরিনা এখানে অপেক্ষা করছি। প্রহরীদের দেখিয়ে ছুটে যাব ক্যাটাকম্বের দিকে। লুকিয়ে পড়ব। ওরা আমাদের পেছনে সময় নষ্ট করবে। ঘণ্টা বাজানর সুযোগ পেয়ে যাবে। তোমরা। যাও!
আসুন! তিন গোয়েন্দাকে বলল মরিডো। এপথে!
গির্জার ভেতর দিয়েও পৌঁছে যাওয়া যায় অন্য টাওয়ারটাতে। আগে আগে ছুটছে মরিডো। পেছনে রবিন, মুসা, তার পরে কিশোর।
পেছনে পড়তে শুরু করল রবিন। হঠাৎ ব্যথা আরম্ভ হয়েছে তার। ভাঙা পায়ে। গতরাত থেকে নিয়ে অনেক বেশি দৌড়াদৌড়ি করেছে। সবে জোড়া লেগেছে পায়ের হাড়। এ-পর্যন্ত সয়েছে, এটাই বেশি।
সবার পেছনে পড়ে গেল রবিন। থামল না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটল। অন্য সময় হলে হেসে মাটিতে গড়াগড়ি করত মুসা। কিন্তু এখন দেখেও দেখল না।
দাঁড়িয়ে পড়েছে আগের তিনজন। বিচিত্র ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে কাছে এসে দাঁড়াল রবিন। আরেকটা বেল-টাওয়ার। প্রথম যেটায়। ঢুকেছিল, তেমনি। তবে এখানে ওপর থেকে একটা মাত্র দড়ি ঝুলে আছে।
লোহার সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল মরিডো। অন্য তিনজন অনুসরণ করল তাকে।
রিঙে বাঁধা দড়ি খুলে দিল মরিডো। ঝুলে পড়ল দড়ির প্রান্ত। দ্রুত সিঁড়ি টপকে ওপরে উঠে চলল সে।
মরিডোর পেছনে উঠে যেতে যেতে পেছনে ফিরে তাকাল একবার কিশোর। না, পড়ে যাবে না রবিন। তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মুসা। উঠে আসছে দ্রুত।
.
১৫.
উঠেই চলেছে ওরা। সিঁড়ি যেন আর ফুরায় না।
ভীষণ ক্লান্ত ওরা। হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে। কষ্ট বেশি হচ্ছে রবিনের।
গতি শ্লথ হয়ে এসেছে চারজনেরই। জিরিয়ে নেবার জন্যে থামল। এই সময় নিচে শোনা গেল চেঁচামেচি।
চমকে নিচে তাকাল ওরা। কয়েকজন প্রহরী এসে দাঁড়িয়েছে। নিচে। চেয়ে আছে ওপরের দিকে। দেখে ফেলল একজন। চেঁচিয়ে উঠল। ছুটে এল সিঁড়ির দিকে।
দুদিক থেকে রবিনের দুই বাহু চেপে ধরল মরিডো আর মুসা। তাকে শূন্যে তুলে নিয়ে আবার টপকাতে শুরু করল সিঁড়ি। খুব পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু থামল না ওরা। পেছনে উঠে আসতে লাগল কিশোর।
সামনে একটা বেশ বড়সড় দরজা। পাল্লা বন্ধ।
কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। জলদি ধাক্কা দিন দরজায়!
ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজা। রবিনকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল মুসা আর মরিডো। কিশোর ঢুকেই বন্ধ করে দিল ভারি পাল্লাটা। বিশাল এক ছিটকিনি। তুলে দিল।
সামনে এমন আরও দুটো দরজা আছে, আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে জানাল মরিডো। আগে, দেশের ভেতরে কোন, গোলমাল দেখা দিলেই ঘণ্টাঘরে গিয়ে ঠাই নিত পাদ্রী আর গির্জার অন্যান্য লোকেরা। ভীষণ শক্ত দূরজা। ভাঙতে সময় নেবে।