রির্বাতোকে অনুসরণ করল দলটা নীরবে।
.
১৪.
বৃষ্টি থেমে গেছে। ঢালু সুড়ঙ্গ বেয়ে নেমে আসা পানি দেখেই বোঝা যায়। পায়ের পাতা ভিজছে এখন শুধু, এতই কম। আস্তে আস্তে আরও কমে যাচ্ছে। লণ্ঠন টর্চ সবই আছে সঙ্গে। একটা জায়গায় এসে ঘোরপ্যাঁচও কমে গেছে। এখন প্রায় সোজা এগিয়ে গেছে সুড়ঙ্গ। দ্রুত হাঁটতে পারছে ওরা।
আচ্ছা, একটা কথা, একসময় বলল রিবাতো। আমেরিকান এমব্যাসির ওদিক দিয়ে যে বেরোব, যদি গার্ড থাকে?
তাই তো! এটা তো ভাবেনি কেউ! অনেকখানি চলে এসেছে ওরা। মনে হচ্ছে, না জানি কত পথ! অথচ নৌকা থেকে নামার পর বড়জোর আট কি দশটা ব্লক পেরিয়ে এসেছে। বেশ চওড়া একটা জায়গায় এসে থেমে গেল রিবাতো। তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যেরাও।
প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ। কিন্তু অব্যবহৃত থাকেনি। ওপরে ম্যানহোল তৈরি হয়েছে। সিঁড়ি না বসিয়ে অন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাড়া পাথরের দেয়ালে গেঁথে দেয়া হয়েছে দুই কোনা লোহার আঙটা।
একই সঙ্গে দুভাবে ব্যবহার করা যায় এটা। হাত দিয়ে ধরা যায়, পা রেখে অনেকটা মইয়ের মতই ওঠা-নামাও যায়।
এখানে দাঁড়ালে কেন? জিজ্ঞেস করল মরিডো। আরও দুটো ব্লক পেরোতে হবে।
বিপদের গন্ধ পাচ্ছি, বলল রিবাতো। জায়গাটায় পাহারা থাকবেই। প্রথমে আমরা কোথায় যাব, এটা ঠিকই আঁচ করে নেবে ওরা। তারপর জায়গা মত ওত পেতে বসে থাকবে। যেই বেরোব, ক্যাক করে চেপে ধরবে গর্ত থেকে বেরোনো ইঁদুরের মত। সেইন্ট ডোমিনিকসের পেছনে রয়েছি আমরা এখন। এই একটা জায়গায় পাহারা থাকার সম্ভাবনা কম। এখান দিয়ে বেরিয়ে বাড়িঘরের আড়ালে আড়ালে চলে যেতে পারব এমব্যাসিতে।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, সায় দিল মরিডো। ঠিক আছে। খামোকা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চল, উঠি।
আঙটা বেয়ে তরতর করে উঠে গেল রিবাতো। ম্যানহোলের ঢাকনাই নেই এখানটায়। কোনকালে খুলে গিয়েছিল কে জানে, লাগানো হয়নি আর। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল একবার সে। তারপর চেঁচিয়ে বলল, একজন একজন করে উঠে আসবে। টান দিয়ে তুলে নেব আমি।
বাইরে বেরিয়ে গেল রিবাতো। গর্তের দিকে মুখ কুঁকিয়ে বসল।
প্রথমে উঠে গেল মেরিনা। ওপরে উঠে হাত বাড়িয়ে দিল। তাকে তুলে নিল রিবাতো।
অন্যেরাও উঠে এল একে একে।
আকাশ মেঘে ঢাকা। গোমড়া সকাল। বিষণ্ণ এক দিনের শুরু। পানি জমে গেছে রাস্তার দুপাশে। খানাখন্দগুলো ভরা।
সরু একটা গলি পথে এসে উঠল ওরা। বাজারের ভেতর দিয়ে গেছে পথ। দুপাশে সারি সারি দোকানপাট। বেশিরভাগই ফুল আর ফলের দোকান। ভিড় কম। মাত্র সকাল হয়েছে। ক্রেতারা আসতে শুরু করেনি এখনও। হয়ত রেডিও-টেলিভিশনের সামনে বসে আছে!
অবাক চোখে ছয়জনের দলটার দিকে তাকাল লোকে। সারা গা ভেজা, ময়লা, চুল উষ্কখুষ্ক, মুখ শুকনো। ঝড়ো কাকের অবস্থা হয়েছে! কারও দিকেই তাকাল না ওরা। নীরবে এগিয়ে চলল দ্রুত।
আগে আগে চলেছে রিবাতো। পঞ্চাশ গজমত গিয়ে থমকে দাঁড়াল। সামনে, মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে দুজন প্রহরী, রয়্যাল গার্ড।
পিছাও! চাপা গলায় আদেশ দিল রিবাতো। লুকিয়ে পড় সবাই!
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। ফিরে চেয়েছে এক প্রহরী। দেখে ফেলেছে। ভেজা কাপড়-চোপড় আর চেহারা দেখেই অনুমান করে নিয়েছে, কারা ওরা। চেঁচিয়ে উঠেই ছুটে এল।
খবরদার! চেঁচিয়ে বলল প্রহরী। পালানর চেষ্টা কোরো না। রিজেন্টের আদেশে অ্যারেস্ট করা হল তোমাদেরকে!
ধরতে হবে আগে, তারপর তো অ্যারেস্ট, ফস করে বলল রিবাতো। পাঁই করে ঘুরেই দৌড় দিল। গির্জার দিকে…এছাড়া আর জায়গা নেই লুকানর…
ছুটতে শুরু করেছে দলের সবাই। লোকজন কেউ সামনে পড়লে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। আশপাশে আরও প্রহরী ছিল। চেঁচামেচিতে ওরাও এসে যোগ দিয়েছে প্রথম দুজনের সঙ্গে। মোট ছজন প্রহরী তাড়া করে আসছে এখন।
ছুটতে ছুটতেই ওপরের দিকে তাকাল রবিন। সামনে বাড়িঘর। ছাতের ওপর দিয়ে চোখে পড়ছে ডোমিনিকসের সোনালি গম্বুজ। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে ও। ভাবছে, গির্জার ভেতর লুকিয়ে কি হবে? ধরা পড়তে সামান্য বিলম্ব হবে, এই যা।
পাশে চেয়ে দেখল, কিশোরও চেয়ে আছে গম্বুজের দিকে। ছুটছে, চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। জরুরি কিছু একটা ভাবছে নিশ্চয় সে। কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করার সময় এখন নেই।
পেছনে, আছাড় খেল এক প্রহরী। তার গায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল আরেকজন। পড়ল আরও দুজন। হৈ হট্টগোল, চেঁচামেচি। আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে এসে তুলছে টেনে।
অনেকখানি এগিয়ে যাবার সুযোগ পেয়ে গেল দলটা। প্রহরীদেরকে পঞ্চাশ গজ পেছনে ফেলে এল ওরা ছয়জন। অবাকই হল রবিন। একই পথ ধরে ছুটে এসেছে ওরা। ওদের কেউ তো আছাড় খেল না! তাহলে ইচ্ছে করেই কি পড়ে গেল সামনের প্রহরীটা! মিনস্ট্রেল পার্টির লোক?
মোড় ঘুরল ছজনে। আর মাত্র একটা ব্লক। তারপরেই সেইন্ট ডোমিনিকস। বিশাল গির্জার ব্লক খানেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন। প্রহরী। চেয়ে আছে এদিকেই।
প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকা যাবে না কিছুতেই।
কিন্তু সেদিকে এগোলও না রিবাতো। রাস্তা পেরিয়ে ছুটে গেল গির্জার পেছনের ছোট একটা দরজার দিকে। শাঁ করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। অন্যেরাও ঢুকে পড়ল তার পেছন পেছন। দরজা বন্ধ করেই। ছিটকিনি তুলে দিল।