আমাদেরও লাগছে! তিনজনের হয়েই বলল মরিডো। যুবককে দেখিয়ে বলল দুই গোয়েন্দাকে, আমার চাচাতো ভাই, রিবাতো৷, বোনের দিকে ফিরল আবার। বাইরে কি ঘটছে, মেরি?
জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল মেরিনা। সামনে হঠাৎ অন্ধকার দূর হয়ে গেছে খানিকটা জায়গায়। আলো এসে পড়েছে। কথা বলার শব্দ। ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ফেলা হয়েছে ওখানটায়।
জলদি! জলদি নৌকা থামাও! চেঁচিয়ে উঠল মেরিনা।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। নৌকা ম্যানহোলের প্রায় তলায় চলে এসেছে। থেম না! চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। সোজা এগিয়ে যাও!
লগি দিয়ে সুড়ঙ্গের মেঝেতে জোরে গুতো মারল রিবাতো। তীরের মত ছুটল হালকা ডিঙি।
সিঁড়ি নেই এখানে। একাধিক সুড়ঙ্গের মিলনস্থল নয় এটা। এখান দিয়ে সাধারণত নামে না কেউ। ওপরে কোন কারণে পানি আটকে গেলে, গর্তের ঢাকনা খুলে দেয়া হয়। পানি সরে যায়। রোজারের লোকেরা হয়ত জানে না এটা। তাই খুলেছে। ভেবেছে, এখান দিয়েই ঢুকবে।
ম্যানহোলের নিচ দিয়ে যাবার সময় ওপরের দিকে তাকাল সবাই। উঁকি দিয়ে আছে একটা মুখ। ডিঙিটা দেখেই চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। পা ঢুকিয়ে দিল দুহাতে ভর রেখে, ছেড়ে দিল শরীরের ভার। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল নৌকাটা। ঝপাং করে পেছনের পানিতে পড়ল লোকটা। নৌকার ওপর পড়ে ওটাকে ঠেকাতে চেয়েছিল, পারেনি।
লগি দিয়ে ওর পেটে এক গুঁতে লাগাল রিবাতো। উ-ক! করে উঠল লোকটা। চেঁচিয়ে উঠল ব্যথায়।
ওপর থেকে আরও একজন প্রহরী পড়ল পানিতে। তার পর পরই আরও একজন। পানি ভেঙে তাড়া করে এল নৌকাটাকে।
আলো নেভাও! চেঁচিয়ে আদেশ দিল মরিডো। অফ করে দাও সুইচ!
ক্ষণেই গভীর অন্ধকার গ্রাস করল ওদেরকে। ম্যানহোল দিয়ে আসা আলো দ্রুত সরে যাচ্ছে পেছনে। স্রোতের টান, তার ওপর লগির। ঠেলায় যেন উড়ে চলল খুদে ডিঙি। সামনের গলুইয়ে বসে দুপাশে হাত ছড়িয়ে দিয়েছে মরিডো। দেয়ালে বাড়ি লাগতে পারে নৌকা, হাত দিয়ে ঠেলে ঠেকাবে।
তাড়া করে আসবেই ওরা, অন্ধকারে বলল মরিডো। তবে পারবে না নৌকার সঙ্গে।
সামনে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে বসে থাকতে পারে, বলল রিবাতো। মেরি, টর্চ জ্বালা তো। সামনেটা দেখে নিই।
জ্বলে উঠল টর্চ। সামনে একটা কক্ষ। আরেকটা সুড়ঙ্গ-সঙ্গম।
পাশের আরেকটা সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ব, বলল রিবাতো। সামনে অপেক্ষা করে থাকলে ব্যাটাদের নিরাশ হতে হবে।
বেশ বড় একটা কক্ষ। তিন দিক থেকে আরও তিনটে সুড়ঙ্গ এসে মিশেছে। একটা সামনে। ওটা প্রধান সুড়ঙ্গ। দুপাশের দুটো সরু। ও দুটো দিয়ে পানি এসে পড়ছে প্রধান সুড়ঙ্গে। দুটোর সবচেয়ে সরু সুড়ঙ্গটাতে নৌকা ঢুকিয়ে দিল রিবাতো।
আবার লণ্ঠন জ্বালল মেরিনা।
স্রোত ঠেলে যেতে হচ্ছে এখন। এগোতে চাইছে না নৌকা। হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে একা রিবাতো। পাটাতনের নিচে আরেকটা লগি আছে, মরিডো।
ছোট লগিটা বের করে নিল মরিডো। দুজনে মিলে বেয়ে নিয়ে। চলল নৌকাটাকে। নিচু ছাত। কোথাও কোথাও এত নিচু, মাথা নুইয়ে। ফেলতে হচ্ছে। তবে, সামনে পথ রুদ্ধ হয়ে নেই কোথাও।
রিবাতোকে চিনতে পারছেন? দুই গোয়েন্দার দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠল মরিডো।
এতক্ষণ উত্তেজনায় খেয়াল করেনি, ভাল করে চাইল এখন রবিন। আরে, তাই তো! চেনা চেনা লাগছে! কোথায় দেখেছে এর আগে! কোথায়,..
ব্যাণ্ড পার্টির সর্দার, বলে উঠল কিশোর। সেদিন পার্কে দেখেছিলাম।
চিনেছেন, বলল মরিডো। আমার আর মেরিনার চেয়ে ভাল চেনে সে এই সুড়ঙ্গ। ওপরে কোথায় কি আছে, তা-ও বলে দিতে পারে শুধু দেয়াল দেখেই।
সামনে আবার নিচু হয়ে আসছে ছাত। ওটা পেরোনর সময় প্রায় শুয়ে পড়তে হল সবাইকে।
পেছনে কারও আসার শব্দ নেই। শুধু দেয়ালে পানি বাড়ি লাগার ছলছলাৎ।
মুসা কোথায়? পেছনে বসে থাকা মেরিনার দিকে চেয়ে বলল কিশোর।
অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে, জানাল মেরিনা। ইচ্ছে করেই রেখে এসেছি। ছোট নৌকা। বোঝা বাড়িয়ে লাভ কি? তাছাড়া, নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে রেখে এসেছি। সবাই একসঙ্গে ধরা পড়ার আশঙ্কাও রইল না।
ঠিকই করেছে মেরিনা, আর কিছু বলল না কিশোর।
কোথায় এলাম আমরা, রিবাতো? জানতে চাইল মরিডো। হারিয়ে-টারিয়ে যাচ্ছি না-তো?
কেন, এদিকটায় আসনি? জবাবের অপেক্ষা না করেই বলল। রিবাতো, ঘুরপথে যাচ্ছি। পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যাব আরেকটা কক্ষে।
এগিয়ে চলেছে নৌকা। মিনিট তিন-চার পরেই আলো দেখা গেল সামনে।
আবার আসছে কে জানি! আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে উঠল রবিন।
আসছে না, অপেক্ষা করছে, জবাব দিল মেরিনা। মুসা।
আরেকটা বড় কক্ষে এসে ঢুকল নৌকা। উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক লণ্ঠন জ্বলছে। পুরানো মরচে ধরা সিঁড়ির ধাপে আরাম করে বসে আছে। গোয়েন্দা সহকারী। রবিন আর কিশোরের দিকে চেয়ে হাসল। ঝকঝক করে উঠল সাদা দাঁত। আহ্, বাঁচা গেল! এসে পড়েছ! আমি তো ভাবছিলাম, আর আসবেই না!
একাই বসে আছ! বলল রবিন।
না, ঠিক একা নয়, দেয়ালের ফাটলগুলোর দিকে তাকাল একবার মুসা। বেশ কয়েকটা ইঁদুর সঙ্গ দিতে এসেছে বার বার। খাতির বেশি হয়ে গেলে গায়ের ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তাই তাড়িয়েছি। বাপরে বাপ! ইঁদুর না-তো! যেন বেড়াল একেকটা!
দেয়ালের একপাশে বিরাট এক গর্ত। ধারগুলো অসমান। মানুষের তৈরি নয়, দেখেই অনুমান করা যায়। দেয়াল তৈরির আগে থেকেই ছিল ওটা ওখানে, তেমনি রেখে দেয়া হয়েছে।