চলতে চলতে দুপাশে অসংখ্য ছোটবড় ফাটল দেখতে পেল ওরা। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ঝাড়া দিয়ে মাথা থেকে পানিতে ফেলে দিল কিছু একটা। তীক্ষ্ণ কাঁচকোঁচ আওয়াজ উঠল ফাটলের ভেতর থেকে।
ইদুর, হেসে বলল মরিডো। পানি বইছে, তাই রক্ষে। নইলে এতক্ষণে হয়ত আক্রমণই করে বসত।
খাবি খেতে খেতে এগিয়ে এল একটা বাদামি রোমশ জীব। টকটকে লাল চোখ। কাছে এসে কিশোরের পা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করল। ঝাড়া দিয়ে ইঁদুরটাকে আবার পানিতে ফেলে দিল সে। স্রোতের ধাক্কায় ভেসে চলে গেল ওটা।
পেছনে মানুষের গলার আওয়াজ শোনা গেল!
ব্যাটারা আসছে! ফিসফিস করে বলল মরিডো। আসছে শুধু ডিউকের ভয়ে। সুড়ঙ্গগুলো চেনে না ওরা। তবু আসতে হচ্ছে।
গতি বাড়াল ওরা। ধীরে ধীরে পানি বাড়ছে, স্রোতও বাড়ছে। আরও খানিকটা এগিয়ে ঝর্না দেখতে পেল। না না, ঝর্না না। খোলা। ম্যানহোল দিয়ে একনাগাড়ে ঝরে পড়ছে, হয়ত রাস্তার পানি।
এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। ভিজতেই হল। চুপচুপে হয়ে গেল। মাথা-গলা-শরীর। ম্যানহোলটা পেছনে ফেলে এল ওরা।
হঠাই বেরিয়ে এল একটা বড়সড় ড্রামের মত গোল কক্ষে। চারপাশের দেয়ালে ছোট বড় গর্ত। সুড়ঙ্গমুখ।চারদিক থেকে এসে প্রধানটার সঙ্গে মিশেছে শাখা-সুড়ঙ্গগুলো। পানি থই থই করছে এখানে। লোহার ঢালু মই উঠে গেছে ওপরের দিকে।
ইচ্ছে করলে এদিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি, বলল মরিডোে। কিন্তু উচিত হবে না। প্রাসাদের কাছাকাছিই রয়ে গেছি এখনও। আসুন, মইটাতে উঠে বসে জিরিয়ে নিই। প্রহরীরা আসতে অনেক দেরি আছে, যদি এতটা আসার সাহস করে ওরা। পানি ঝরছে যে, ওই ম্যানহোেলটার ওপাশ থেকেই ফেরত যেতে পারে হয়ত।
দুই ফুট চওড়া একেকটা ধাপ। তিনটা ধাপে উঠে বসল তিনজনে।
হেলান দিতে গিয়েই ককিয়ে উঠল কিশোর। ছোঁয়াতে পারছে না পিঠের নিচের অংশ। উত্তেজনায় ব্যথা টের পায়নি এতক্ষণ।
কি হল, মুখ তুলে তাকাল রবিন আর মরিডো।
কিছু না। পিঠে চোট পেয়েছি। সামান্য।
শেষ পর্যন্ত তাহলে পালাতে পারলাম! জোরে একটা শ্বাস ফেলে বলল রবিন। এতটা যখন চলে এসেছি, আর ধরতে পারবে না।
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মরিডো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, বাতি নিভিয়ে ফেলুন! জলদি!
সঙ্গে সঙ্গে বাতির সুইচ অফ করে দিল দুই গোয়েন্দা।
ড্রামের মৃত গোল দেয়ালের গায়ে বড় বড় দুটো গর্ত, প্রধান সুড়ঙ্গের দুটো মুখ। বাকিগুলো সব ছোট ছোট। ওগুলো দিয়ে ঢোকা যাবে না। বড় দুটো গর্তের একটা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা খানিক আগে। ওটা দিয়েই আসছে প্রহরীরা। দ্বিতীয় মুখ, যেটা দিয়ে এগিয়ে যাবে ভেবেছিল, ওটাতে আলো দেখা যাচ্ছে। ওদিক থেকেও আসছে লোক!
তারমানে, ফাঁদে পড়ে গেছে তিনজনে।
১৩.
ওপরে উঠুন! চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। ঢাকনা খুলে বেরিয়ে যাব!
ভেজা পিচ্ছিল সিঁড়ির ধাপে পা রেখে রবিন আর কিশোরকে ডিঙিয়ে দ্রুত উঠে চলে গেল মরিডো। তার পেছনে উঠল দুই গোয়েন্দা। পাশাপাশি দাঁড়ানর জায়গা নেই। ওরা এক ধাপ নিচে রইল।
অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। অনুমানে ওপর দিকে হাত বাড়াল মরিডো। হাঁতে লাগল লোহার ঢাকনা। ঠেলা দিল। টান দিয়ে তোলার চেয়ে ঠেলা দিয়ে তোলা সহজ, বেশি জোর করা যায়। কিন্তু তবু প্রথমবারের চেষ্টায় উঠল না ঢাকনা।
আরেক ধাপ উঠে গেল মরিডো। কাঁধের একপাশ ঠেকাল ঢাকনার তলায়। ঠেলা দিল গায়ের জোরে। নড়ে উঠল ঢাকনা। ফাঁক হয়ে গেল। চাপ কমিয়ে দিল সে। হাত দিয়ে ঠেলে আরও খানিকটা ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিল। সঙ্গে সঙ্গেই নামিয়ে আনল মাথা। ছেড়ে দিল ঢাকনা। বন্ধ হয়ে গেল ওটা আবার।
দুজন গার্ড! মোড়ের কাছে অপেক্ষা করছে! ফিসফিস করে জানাল মরিডো।বেরোলেই কাঁক করে এসে চেপে ধরবে!
এখানেই যদি চুপ করে বসে থাকি? বলল কিশোর। হয়ত দেখতে পাবে না আমাদের।
এছাড়া করারও কিছু নেই, হতাশ কণ্ঠ মরিডোর। বসে থাকব। চুপ করে। কপাল ভাল হলে বেঁচে যাব!
আলো বাড়ছে সুড়ঙ্গে। এগিয়ে আসছে, বোঝাই যাচ্ছে। পানিতে ঝিলমিল করছে আলো।
হঠাৎ বেরিয়ে এল একটা ছোট ডিঙি। সামনের গলুইয়ের কাছে বসে আছে একজন, মাঝে আরেকজন। নৌকার পাটাতনে রাখা লণ্ঠন। গলুইয়ে বসা লোকটার হাতে একটা লগি।
মরিডো। ডেকে উঠল মাঝে বসা মেয়ে কণ্ঠ। মরিডো, আছ ওখানে? ওপরের দিকে তাকাল সে।
মেরিনা! আনন্দে জোরে চেঁচিয়ে উঠেই আবার স্বর খাদে নামাল মরিডো। মেরি, আমরা এখানে!
থেমে গেল নৌকা। হাত বাড়িয়ে পাশে রাখা টর্চ তুলে আলো ফেলল মেরিনা। চুপচুপে ভেজা ইঁদুরের মত সিঁড়ির ধাপে বসে আছে ওরা তিনজন।
প্রিন্স পলকে ধন্যবাদ! চেঁচিয়ে উঠল মেরিনা। আমরা তো ভেবেছিলাম, বেরোতেই পারবে না!
দেয়ালের ফাটলে লগির মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে নৌকাটাকে এক জায়গায় স্থির রাখল যুবক। তাড়াহুড়ো করে নেমে এল কিশোর, রবিন আর মরিডো। সঙ্গে সঙ্গেই লগিটা খুলে আনল যুবক। মেঝেতে লগি ঠেকিয়ে জোরে ঠেলা দিল। শাঁ করে আবার ঢুকে পড়ল নৌকাটা যে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়েছিল, সেটার ভেতরে।
একজন গার্ড তোমার মেসেজ দিয়েছে আমাকে, মেরিনাকে বলল মরিডো।
কয়েক ঘণ্টা যাবৎ তোমাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, জানাল মেরিনা। জানি, মেসেজ পেলে যে করেই হোক বেরিয়ে পড়বেই তোমরা। এদিকে আরও দুবার খুঁজে গেছি। এবারে না পেলে ধরেই নিতাম, মেসেজ পাওনি।…ওহ, মরিডো, তোমাদের দেখে কি-যে খুশি লাগছে।