ছুটে এল দ্বিতীয় প্রহরী। দরজার পাশেই অপেক্ষা করছে মরিডো। চোখের পলকে পায়ে আর গলায় একটা করে ফাঁস আটকে গেল দ্বিতীয় লোকটারও। হাতে আটকাল আরেকটা।
দ্বিতীয় প্রহরীর কানে কানে ফিসফিস করে বলল মরিডো। ছাড়া পাবার ভান করতে থাক! চুপ করে থেক না।
হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগল লোকটা।
শক্ত করে দুই প্রহরীকেই বেঁধে ফেলা হল। নড়ার উপায় রইল না আর ওদের।
মেঝেতে পড়ে থাকা লোক দুটোর দিকে চেয়ে হাসল মরিডো। মাকড়সার জালে আটকা পড়া পোকার অবস্থা হয়েছে যেন প্রহরীদের। শুভ লক্ষণ! আশা আর উদ্যম আবার ফিরে এল তার।
জলদি করুন! দই গোয়েন্দাকে বলল মরিডো। করিডরের অন্য মাথায় প্রহরী থাকতে পারে। চেঁচামেচি শুনলে ছুটে আসবে ওরা। লণ্ঠন তুলে নিন।
করিডরে বেরিয়ে এল মরিডো। পেছনে কিশোর আর রবিন। সামনে গাঢ় অন্ধকার। সেদিকেই ছুটল ওরা। ছোটার তালে তালে নাচছে বৈদ্যুতিক লণ্ঠনের আলো।
করিডরের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। সিঁড়ি নেমে গেছে। এক মুহূর্ত। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল মরিডো। একেক লাফে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকাচ্ছে। তাকে অনুসরণ করল দুই গোয়েন্দা।
সিঁড়ির শেষ ধাপের কাছেই একটা ম্যানহোল। লোহার ভারি ঢাকনা। কোনকালে শেষ খোলা হয়েছিল, কে জানে! মরচে পড়ে বাদামি হয়ে গেছে, তার ওপর পুরু হয়ে জমেছে ধুলো।
ঢাকনার রিঙ ধরে টান দিল মরিডো। নড়াতে পারল না। আবার টান দিল গায়ের জোরে। কোন কাজ হল না। অটল রইল ঢাকনা।
আটকে গেছে! ফাঁসাসে আওয়াজ বেরোল মরিডোর গলা থেকে। মরচে! নড়াতে পারছি না!
জলদি! বলে উঠল কিশোর। জলদি দড়ি ঢোকান রিঙের ভেতর। সবাই ধরে টান দেব!
ঠিক! দ্রুত কোমরে পেঁচানো দড়ি খুলে নিতে লাগল মরিডো।
সবটা খোলার দরকার হল না। একটা প্রান্ত রিঙের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। শক্ত করে ধরল তিনজনে। টান লাগাল।
নড়ল না ঢাকনা।
ওরাও নাছোড়বান্দা। টান বাড়াল আরও, আরও…! পেছনে পায়ের শব্দ। দ্রুত এগিয়ে আসছে। আর সময় নেই। হ্যাঁচকা টান লাগাল ওরা। অটল থাকতে পারল না আর ঢাকনা। নড়ে উঠল!
ঠনন আওয়াজ তুলে পাথরের মেঝেতে উল্টে পড়ল ভারি ঢাকনা। গর্তের ভেতরে কালো অন্ধকার। পানি বয়ে যাবার শব্দ আসছে।
আমি আগে যাই, টেনে রিঙের ভেতর থেকে দড়িটা খুলে আনতে আনতে বলল মরিডো। দড়ি ধরে থাকবেন। তাহলে হারানর ভয়। থাকবে না।…নাহ, এসে গেছে ব্যাটারা! ঢাকনা বন্ধ করে যাবার আর সময় নেই…
গর্তের ভেতরে পা রাখল মরিডো। দড়ির একটা প্রান্ত ধরে রেখে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।
দড়ির মাঝামাঝি ধরেছে রবিন। লণ্ঠনের সরু হ্যাঁণ্ডেল ধরে রেখেছে। দাঁতে কামড়ে। গর্তের দিকে চেয়ে কেঁপে উঠল একবার। ওই অন্ধকার মোটেই ভাল লাগছে না তার। নিচ থেকে আসা পানির আওয়াজও কানে সুধা বর্ষণ করছে না। কিন্তু তবু যেতেই হবে। মুহূর্ত দ্বিধা করেই। ভেতরে পা রাখল সে।
হাঁটু অবধি পা ঢুকিয়ে দিল রবিন। কিছুই ঠেকল না। তবে কি সিঁড়ি নেই! না না আছে। লোহার মই। খাড়া। নেমে পড়ল সে। এক ধাপ…দুই ধাপ…পা পিছাল হঠাৎ করেই। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারল না ম্যানহোলের কিনারা।
রবিনের মনে হল, পতন আর কোন দিন শেষ হবে না। কিন্তু হল। প্রাচীন পাথুরে নর্দমার তলায় এসে নামল নিরাপদেই। গর্তের মুখ থেকে উচ্চতা বড় জোর সাত-আট ফুট হবে। কোনরকম আঘাত পায়নি, কারণ হাঁটু পানিতে পড়েছে। তাছাড়া, পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ধরে ফেলেছে মরিডো।
চুপ, কানে কানে বলল মরিডো। ওই যে, কিশোর। সরুন। নামার জায়গা দিন।
কিশোরও পা পিছলাল। তবে রবিনের মত নিরাপদে নামতে পারল না। সড়াৎ করে পিছলে গেল। ধপ করে পড়ে গেল পাথরের মেঝেতে চিত হয়ে। মইয়ের গোড়ায় মাথা বাড়ি লাগার আগেই ধরে ফেলল তাকে মরিডো। টেনে তুলল।
বাপরে বাপ! ঠাণ্ডা!…উফফ, মেরুদণ্ডটা ভেঙেই গেছে! হাঁসফাস করে উঠল গোয়েন্দাপ্রধান।
বৃষ্টির পানি, তাড়াতাড়ি বলল মরিডো। ময়লা নেই। চলুন, কেটে পড়ি। দড়ি ছাড়বেন না কিছুতেই। পথ হারাবেন তাহলে। নদীর দিকে বয়ে যাচ্ছে পানি। ড্রেনের মুখে লোহার মোটা মোটা শিক…
মাথার ওপরে চিৎকার শুনে চুপ হয়ে গেল মরিডো। লণ্ঠন ঝুলছে, আলো।
সরে এল তিনজনে। হাঁটতে শুরু করল।
কয়েক গজ এগিয়েই নিচু হয়ে এল সুড়ঙ্গের ছাত। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। মাথা সামান্য নুইয়ে রাখতে হচ্ছে। হাঁটুর নিচে পানির তীব্র স্রোত। পিচ্ছিল মেঝে। অসতর্ক হলেই আছাড় খেতে হবে।
ম্যানহোলের মুখে অনেক লোকের চেঁচামেচি। একটা মোড় ঘুরতেই আলো আর দেখা গেল না।
ধীরে ধীরে দূরে, অনেক দূরে মিলিয়ে গেল যেন চেঁচামেচি। আসলে খুব বেশি এগোয়নি ওরা। ম্যানহোল দিয়ে সুড়ঙ্গের ভেতরে বাইরের শব্দ আসতে পারছে না ঠিকমত।
সুড়ঙ্গের একটা মিলনস্থলে এসে পৌঁছুল ওরা। আরেকটা সুড়ঙ্গের সঙ্গে আড়াআড়ি মিলিত হয়েছে প্রথমটা। যেমন উঁচু তেমনি চওড়া। ওটাতে ঢুকে পড়ল ওরা।
দাঁড়ানো যাচ্ছে এখন সোজা হয়ে। ছাতে মাথা ঠেকছে না। পানি বেশি বড় সুড়ঙ্গটায়, স্রোতও বেশি। শাখা-সুড়ঙ্গগুলো থেকে এসে, এটাতে পড়ছে পানি। কলকল ছলছল আওয়াজ তুলছে পাথরের দেয়ালে বাড়ি দিয়ে। শক্ত করে দড়ি ধরে রেখেছে ওরা। বৈদ্যুতিক লণ্ঠনের আলোতেও কাটতে চাইছে না সামনে পেছনের ঘন কালো অন্ধকার। স্রোতের বিপরীতে এগোতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।