গাড়ি পার্ক করল শোফার। নেমে পড়ল ছেলেরা। কালো গাড়ি থেকে প্রহরীরা নেমে পড়েছে আগেই।
ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে চলল ডিউক আর তার দলবল।
একটা জায়গায় এসে একটু পিছিয়ে পড়ল ডিউক, কিশোরের একেবারে গা ঘেঁষে এল দিমিত্রি। ফিসফিস করে বলল, ওদের ফাঁকি দিতে হবে। গায়ের ওপর থেকে খসাতে হবে!
আস্তে করে মাথা ঝোকাল কিশোর।
পুরো পার্ক চক্কর দিচ্ছে ছোট ট্রেন, বিচিত্র রঙের ইঞ্জিন, কামরা। খুদে স্টেশনে লোকের ভিড়। ওখানে এসে দাঁড়াল চার কিশোর। স্টেশনে এসে থামল একটা ট্রেন। পিলপিল করে নেমে এল যাত্রীরা। বেশির ভাগই বাচ্চা ছেলেমেয়ে। ওদের ভিড়ে মিশে গেল চারজনে। নতুন যাত্রী উঠল ট্রেনে। হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে দেবার আগের মুহূর্তে লাফিয়ে একটা বগিতে উঠে বসল চার কিশোর। ডিউককে দেখতে পেল ওরা। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে ছেলেমেয়েদের মাঝে খুঁজছে দিমিত্রিকে। সরে চলে এল ট্রেন।
ট্রেনে বসেই পার্কের অনেক কিছু চোখে পড়ে। দেখল দিমিত্রি। কোটা কি; বুঝিয়ে দিল তিন গোয়েন্দা। বেশ আনন্দেই কাটল সময়টা। পুরো পার্ক একবার চক্কর দিয়ে আবার স্টেশনে এসে থামল গাড়ি। দাঁড়িয়ে আছে ডিউক লুথার। তাকে ঘিরে রয়েছে দেহরক্ষীরা। মুখচোখ কালো। নিশ্চয় প্রচুর বকাঝকা খেতে হয়েছে ডিউকের কাছে।
ট্রেন থামতেই চার কিশোরকে দেখে ফেলল ওরা। ছুটে এসে দাঁড়াল বগির সামনে।
মুখ গোমড়া করে ট্রেন থেকে নামল দিমিত্রি। ঝঝাল কণ্ঠে বলল, আমার সঙ্গে থাকনি তোমরা! ডিউটি ফাঁকি দিয়েছ। রিপোর্ট করব আমি ডিউক রোজারের কাছে।
কিন্তু…আ-আমি… তোতলাতে শুরু করল লুথার।
থাম! ধমকে উঠল দিমিত্রি। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে বলল, চল, যাই। ইসস, আরও সময় হাতে নিয়ে আসা উচিত ছিল! কত কিছু দেখার আছে আমেরিকায়!
তিন বন্ধুকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল দিমিত্রি। পেছনের প্রহরী গাড়িতে করে আসার আদেশ দিল ডিউক লুথারকে। শোফার ইংরেজি জানে না। রকি বীচে ফেরার পথে মন খুলে কথা বলতে পারল চারজনে।
অনেক কিছু জানতে চাইল রাজকুমার। খুলে বলল সব তিন গোয়েন্দা। কি করে একসঙ্গে হয়েছে ওরা, কি করে গোয়েন্দা হওয়ার শখ জেগেছে, কি করে দেখা করেছে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের সঙ্গে, সব জানাল। সংক্ষেপে বলল ভূতুড়ে দুর্গ আর কঙ্কাল দ্বীপ অভিযানের কাহিনী।
ব্রোজাস! শুনতে শুনতে এক সময় চেঁচিয়ে উঠল দিমিত্রি। কি। আনন্দ! একেই বলে জীবন! আহা, আমেরিকান ছেলেরা কত স্বাধীন! ইসস, কেন যে রাজকুমার হয়ে জন্মালাম! আর কদিন পরেই কাঁধে চাপবে মস্ত দায়িত্ব। রাজ্য শাসন…আরিব্বাপরে! ভাবলেই হাত-পা হিম। হয়ে আসে!…স্বাধীন হব, হুহু! বাড়ি থেকেই বেরোতে দেয়া হয় না আমাকে! জীবনে কোনদিন স্কুলের মুখ দেখিনি! বাড়িতে শিক্ষক রেখে পড়াশোনা করিয়েছে! হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু আছে আমার, দেশে।…সত্যি বলছি, জীবনে এই প্রথম কয়েক ঘণ্টা আনন্দে কাটালাম! আজকের দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার জীবনে!
খানিকক্ষণ নীরবতা। তোমরা আমার বন্ধু হবে? অযাচিতভাবে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল দিমিত্রি। খুব খুশি হব!
আমরাও খুব খুশি হব, বলল মুসা।
থ্যাঙ্ক ইউ! হাসল রাজকুমার। তোমরা জান না, জীবনে আজই প্রথম তর্ক করেছি ডিউক লুথারের সঙ্গে। তোমাদের সঙ্গে মিশেছি, এটা মোটেই ভাল লাগছে না তার। জানি, ফিরে গিয়ে সব লাগাবে রিজেন্টের কাছে। ব্যাপারটা মোটেই ভালভাবে নেবে না রোজার। না নিক। আর মাত্র দুয়েকটা মাস। তারপর ওদের পরোয়া কে করে!
প্রিন্সের কথা নিশ্চয় না মেনে পারবে না ডিউক রোজার, বলল রবিন।
না, পারবে না, বলল দিমিত্রি। সময় আসুক। বেশ কয়েকটা আঘাত অপেক্ষা করছে তার জন্যে! রহস্যময় শোনাল রাজকুমারের গলা।
রকি বীচে পৌঁছে গেল গাড়ি। দিমিত্রিকে বলে গেল কিশোর, কোন্ পথে যেতে হবে। দিমিত্রি তার ভাষায় বলল শোফারকে।
পাশা, স্যালভেজ ইয়ার্ডের বিশাল লোহার গেটের সামনে পৌঁছে গেল গাড়ি।
দিমিত্রিকে নামতে অনুরোধ করল কিশোর। ওদের হেডকোয়ার্টার দেখাবে।
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল দিমিত্রি। না রে, ভাই, সময় নেই। আজ রাতে এক জায়গায় ডিনারের দাওয়াত আছে। আগামীকাল সকালেই ফিরে যাব ভ্যারানিয়ায়।
রাজধানীতেই থাক নিশ্চয়? জানতে চাইল কিশোর। নাম কি?
হ্যাঁ। ডেনজো। কখনও গেলে দেখবে, কত বড় বাড়িতে থাকি! কয়েকশো বছর আগে তৈরি হয়েছিল বিশাল দুর্গের মত বাড়িটা। তিনশো কামরা। বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ছোট রাজ্য। আয় খুবই কম। বাড়ি মেরামত করারও পয়সা নেই আমাদের। অথচ রাজা!…নাহ্, আর দেরি করতে পারছি না। চলি। আবার হয়ত কখনও দেখা হবে, মাই ফ্রেণ্ডস!
বন্ধুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গিয়ে লিমোসিনে উঠল দিমিত্রি। রাজকুমারের গা ঘেঁষে বসল লুথার। দেহরক্ষীরা উঠল।
ছেড়ে দিল গাড়ি। প্রতিটি জানালায় শুধু দেহরক্ষীর মুখ। লিমোসিনের পেছনে কালো এসকর্ট কার।
গাড়ি দুটো মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যাবার পরেও অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল তিন গোয়েন্দা।
একজন রাজকুমার এত ভাল হতে পারে, জানতাম না! কথা বলল, মুসা। কিশোর, কি ভাবছ? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করেছ…।
চোখ মিটমিট করে তাকাল কিশোর। ঠোঁট থেকে সরিয়ে নিল আঙুল। ভাবছি…নাহ্, সত্যি আশ্চর্য।