আমি জানতে চাইছি রূপালী মাকড়সার কথা। মনে পড়ছে কিছু?
না। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রবিন।
হুমম! অনেক সময় দ্বিতীয়বার মাথায় চোট লাগলে চলে যায় অ্যামনেশিয়া। ফিরে আসে স্মৃতি।
আসেনি, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল রবিন। কয়েকটা মিনিট এখনও ফাঁকা!
এটা বরং ভালই হল, বলে উঠল মরিডো। যতই চাপাচাপি করুক ডিউক রোজার, রূপালী মাকড়সার খোঁজ জানতে পারবে না।
ঠিক এই সময় চাবির গোছর শব্দ হল বাইরে। খুলে গেল ভারি দরজা। দুজন লোক। রয়্যাল গার্ডের ইউনিফর্ম পরা। বুটের গট গট শব্দ তুলে ভেতরে এসে ঢুকল ওরা। হাতে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক লণ্ঠন। উজ্জ্বল আলো। দুজনেরই ডান হাতে ঝকঝকে খোলা তলোয়ার।
এস, ভারি মোটা একটা কণ্ঠস্বর। ডিউক রোজার অপেক্ষা করছেন। ওঠ। আমাদের মাঝখানে থাকবে। চালাকির চেষ্টা করলে বুঝবে মজা! তলোয়ার তুলে শাসাল সে।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল তিন বন্দি। আগে রইল এক প্রহরী, পেছনে অন্যজন। নিয়ে চলল বন্দিদের।
সরু অন্ধকার একটা করিডরে বেরিয়ে এল ওরা। বাতাসে ভাপসা গন্ধ। পায়ের তলায় পাথরের মেঝে কেমন ভেজা ভেজা, ঘেমে উঠেছে। যেন। সামনে পেছনে দুদিকেই অন্ধকার।
ঢালু হয়ে উঠে গেছে করিডর। একটা জায়গায় এসে থেমেছে সিঁড়ির গোড়ায়। কয়েক ধাপ সিঁড়ির পরেই আবার শুরু হয়েছে করিডর। দুপাশে সারি সারি লোহার দরজা। নিশ্চয় কয়েদখানা। এই করিডরের পরে আবার কয়েক ধাপ সিঁড়ি। ওপরে আরেকটা করিডরের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন প্রহরী।
প্রহরীদের মাঝখান দিয়ে করিডরে উঠে এল ওরা। এখোল। সামনে, একপাশের একটা দরজা খোলা। উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে করিডরে। দরজার সামনে বন্দিদেরকে নিয়ে আসা হল। একবার ভেতরে চেয়েই শিউরে উঠল কিশোর আর রবিন। এই ধরনের ঘর এর আগেও দেখেছে ওরা, ভয়াল ছায়াছবিতে। শত শত বছর আগেকার, মধ্যযুগীয় পীড়ন ঘর। তবে এটা ছায়াছবি নয়, বাস্তব।
পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হল ওদের। লম্বা একটা ঘর। বিচিত্র, কুৎসিত সব জিনিসপত্র। নির্যাতনের যন্ত্র। একপাশে কুৎসিত একটা ব্ল্যাক থেকে ঝুলছে এক হতভাগ্য। লোহার শেকলে বাঁধা কব্জি। পায়ের সঙ্গে শেকল দিয়ে বেধে ঝুলিয়ে দিয়েছে ভারি পাথর। লম্বা হয়ে গেছে লোকটা। মাঝখান থেকে দুটুকরো হয়ে ছিঁড়ে যাবে আরেকটু টান পড়লেই। পরনে একটা সুতোও নেই। হাড়ের ওপর কটুচকে জড়িয়ে আছে শুকনো চামড়া।
আরেকদিকে বিশাল একটা গোল পাথর, গম ভাঙার যাতার মত দেখতে, তবে অনেক বড়। ওটার গায়ে টান টান করে আটকে দেয়া হয়েছে আরেকটা মানুষকে। এক এক করে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাঙা হয়েছে হাত-পায়ের হাড়।
আরও সব বিচিত্র যন্ত্রপাতি। বেশির ভাগেরই নাম জানা নেই কিশোর কিংবা রবিনের। পাথর, লোহা কিংবা কাঠের তৈরি। ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ছয় ফুট লম্বা এক লোহার মেয়েমানুষ। ওই জিনিস আগেও দেখেছে কিশোর, সিনেমায়। আয়রন মেইডেন বা লৌহমানবী নাম। আসলে মেয়েমানুষের আকৃতির একটা লম্বা বাক্স ওটা। একপাশে কজা। টান দিয়ে বাক্সের ডালা খোলার মতই খোলা যায়। ভেতরের দেয়ালে চোখ কাটা বসানো। বন্দিকে ধরে তার ভেতরে ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে ডালা বন্ধ করা হয়। শরীরে ঢুকে যেতে থাকে অসংখ্য কাটা। কাটাগুলোর মাধ্যায় আবার এক ধরনের ওষুধ মাখিয়ে রাখা হয়। রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে যন্ত্রণা শতগুণে বাড়িয়ে তোলে বন্দির।
টর্চার রুম! ফিসফিস করে বলল মরিডো। কাঁপছে গলা। এটা তৈরি হয়েছে সেই ব্ল্যাক প্রিন্স জনের আমলে। ভয়াবহ এক পিশাচ ছিল লোকটা। মধ্যযুগের সবচেয়ে অত্যাচারী সাত আটজন শাসকের একজন। ওর পরে এই ঘর আর কেউ ব্যবহার করেনি বলেই জানতাম। কিন্তু এখন তো দেখছি অন্যরকম! ডিউক রোজার গোপনে ঠিকই ব্যবহার করছে এটা!
পেটের ভেতরে অদ্ভুত একটা শিরশিরে অনুভূতি হল কিশোরের। একসঙ্গে ঢুকে পড়েছে যেন কয়েক ডজন প্রজাপতি, ডানা নাড়ছে! আড়চোখে দেখল, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রবিনের চেহারা। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।
চুপ! ধমকে উঠল এক প্রহরী। ডিউক রোজার আসছেন।
ম্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে দরজার দুপাশে দুজন প্রহরী। বুটের খটাশ শব্দ তুলে স্যালুট করল।
গটমট করে হেঁটে এসে ঘরে ঢুকল ডিউক রোজার। পেছনে এল। ডিউক লুথার মরিজ।
বন্দিদের সামনে এসে দাঁড়াল রোজার। কুৎসিত হাসি ফুটল ঠোঁটে। ইঁদুরের বাচ্চারা, ফাঁদে পড়লে শেষে! এইবার খেচানো হবে চোখা শিক দিয়ে। যত খুশি, গলা ফাটিয়ে চেঁচিও। কোন আপত্তি নেই। তারপর গড়গড় করে জবাব দিয়ে যাবে আমার প্রশ্নের। নইলে…
ধুলো ঝেড়ে একটা চেয়ার নিয়ে এসে পেতে দিল এক প্রহরী। বসে পড়ল তাতে রোজার। আরেকটা লম্বা বেঞ্চ এনে পেতে দেয়া হল। তাতে রোজারের মুখোমুখি বসিয়ে দেয়া হল তিন বন্দিকে।
চেয়ারের হাতলে আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে টোকা দিল রোজার। তারপর, মরিডো, তুমিও আছ এর মধ্যে বেশ! টের পাবে তোমার বাবা, পুরো পরিবার। তোমার কথা বাদই দিলাম।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে মরিডো। কোন জবাব দিল না।
তারপর? আমেরিকান বিচ্ছুরা? রোজারের গলায় কেমন খুশির আমেজ। ধরা তো পড়লে। একটা অবশ্য গেল পালিয়ে। তাতে কিছু যায় আসে না। এবার কিছু প্রশ্নের জবাব দেবে আমার? না না, তোমরা কেন এসেছ, জানতে চাই না। সেটা ক্যামেরাগুলোই জানিয়ে দিয়েছে। ভ্যারানিয়ার বিরুদ্ধে গুপ্তচরগিরি করতে এসেছ। মস্ত অপরাধ। তার চেয়ে বড় অপরাধ করেছ রূপালী মাকড়সা চুরি করে। সামনে ঝুকল। হঠাৎ চেহারা থেকে চলে গেল খুশি খুশি ভাবটা। কোথায় ওটা?